
ইচ্ছে
কাঁথামুড়ি দেওয়া দেহটায় যে মৃদু শ্বাসপ্রশ্বাস চলছে, খুব ভালোভাবে লক্ষ না করলে বোঝা যায় না। উত্তুরে জানালাটা খোলা; ফিনফিনে সাদা পর্দাটা উড়ছে সদ্যঋতুবতীর হঠাৎ নিত্যবস্তু হয়ে ওঠা অপাঙক্তেয় ওড়নার মতো। বিছানার দুপাশে দাঁড়িয়ে দুজন—কৃষ্ণকায় পোশাকাবৃত মৃত্যুদূত আর শ্বেতশুভ্র বেশাচ্ছাদিত আরোগ্য-দেবদূত।
মৃত্যুদূত গম্ভীরভাবে বলেন, ‘যা করার দুমিনিটের ভেতরে করবেন। আপনার সঙ্গে ব্যক্তিগত সম্পর্কের খাতিরে এইটুকু ছাড় দিচ্ছি, কিন্তু ওপরে গিয়ে কিছু জানাবেন না।’ কথাগুলো বলে তিনি একটু দম নেন। সারাদিন পৃথিবীময় ছুটোছুটি করে বেড়াতে হয়, ক্লান্তি আসা অস্বাভাবিক নয়। ‘কিন্তু আমার অবাক লাগছে এই ভেবে যে, আপনি লোকটার সাথে ঠিক কী করতে চাইছেন? আমি তো একটু আগেই তালিকা দেখলাম, লোকটার আরোগ্যলাভের সময় এখনো আসেনি। অন্তত মাসখানিক দেরি আছে।’ বিস্ময় গোপন করেন না তিনি।
দেবদূত উত্তর না দিয়ে মৃদু হাসেন। ধীরে ধীরে হাওয়ায় ভর করে এগোন লোকটার মাথার দিকে। মৃত্যুদূত ব্যস্ত হয়ে পড়েন তালিকা নিয়ে। এরপর ইয়েমেনের শিশুটা অপুষ্টিতে মরবে, এরপর নরওয়ের উত্তরে ছোট্ট গ্রামে স্ত্রীর কাছ থেকে প্রতারিত হওয়া বিষণ্ণ যুবকটি সিলিং থেকে ঝুলে পড়বে, এরপর নেপালের রাস্তায় বাস-লরির ধাক্কায়—সর্বনাশ! এ-যে বেশ বড়ো ব্যাপার। তাড়াতাড়ি স্পটে যেতে হবে।
মৃত্যুদূতের অলক্ষে ওদিকে দেবদূত শায়িতের চুলে সস্নেহে হাত বোলান কিছুক্ষণ। তারপর হঠাৎ তুলে নেন পাশের বালিশটা, শক্ত করে চেপে ধরেন মুখের ওপরে। কয়েকবার ঝাঁকি খেয়ে দেহটি স্থির হয়।
মৃত্যুদূত রীতিমতো হতভম্ব হয়ে যান—‘আরে, একী করলেন? এই কাজ কি আপনার? নোটিফিকেশন আসার আগেই—উফ! আচ্ছা, মারতে চাইলে কি মারা যেতো না? কিন্তু তার তো একটা প্রসেস আছে, পেপারওয়ার্ক আছে। আপনার মতো পুরোনো লোককেও যদি জব ডেসক্রিপশন নতুন করে শেখাতে হয়—’
দেবদূত ক্লান্তভাবে বলেন, ‘আপনি তো অহরহই মারছেন, আপনাকে তো প্রসেস ফলো করতে দেখি না।’
‘আহা, ছেলেমানুষের মতো কথাবার্তা বললে তো হবে না। আমার অথোরাইজেশন আছে। আপনি তো একই প্রিভিলেজ পাবেন না। এই যে আপনি যাকে ইচ্ছা ফটাফট সুস্থ করে ফেলেন, আমি কি পারবো?’
‘তাহলে আপনার আজকের দিনটা আমায় দিন।’ দেবদূত কাতরোক্তি করেন।
মৃত্যুদূত কড়াভাবে বলেন, ‘মোটেই না। আপনি অলরেডি ভালো ঝামেলা পাকিয়ে ফেলেছেন। এইচআর জানতে পারলে আমার চাকরিটাই থাকবে না। ধুর, কেন যে আপনার কথা শুনতে গেলাম!’
দেবদূত বিষণ্ণগলায় বলেন, ‘কিন্তু আজ যে আমার খুব ইচ্ছে করছে মানুষ খুন করতে।’
০৭ জুলাই, ২০১৬
মাস্টারদা সূর্য সেন হল
