কিছু অনশ্বর জলপাইয়ের কথা

কদিন দ্বিপ্রহরে উঠোনের বড়ো গাছটা থেকে একটা কাঁচা জলপাই খসে পড়ে।

হয়তো গতরাতে তাকে চেখে দেখতে গিয়ে বৃন্তচ্যুত করে গেছিলো একটি বেয়াড়া চামচিকে। চামচিকেরা অবশ্য টক ভালবাসে না। কিন্তু কে জানে—হয়তো নিশুতিরাতে দলবেঁধে যেতে যেতে হঠাৎ এক দস্যুপ্রকৃতির চামচিকের উদ্ভট শখ হয়েছিলো মোচাকৃতির অবয়বটিতে ঠোকর দেওয়ার। প্রগাঢ় অন্ধকারে চাপা পড়া সেইসব আপাত-অপ্রয়োজনীয় কিন্তু ভীষণ বাস্তব গল্প জানার উপায় কোথায়?

কিংবা আসলেই কি উপায় নেই? লেখক বিভ্রান্ত হন। অন্যকে উল্টোসিধে যাইহোক কিছু-একটা বিশ্বাসযোগ্য ইতিবৃত্ত গেলানোর তীব্র অভিলাষ এবং সুদীর্ঘ ইতিহাস—দুই-ই আছে তাঁর। এত সহজে তিনি হাল ছাড়বেন বলে মনে হয় না। লেখকের এই চিন্তাধারা অবশ্য আমি পছন্দ করি—ফলে তাঁকে সঙ্গ দিতে শুরু করি।

গাছটি যে-বাড়ির উঠোনে, তার তরুণী গৃহকর্ত্রী গতকাল জলপাইয়ের মোরব্বা বানিয়েছে। এর প্রস্তুতপ্রণালী সে শিখেছিলো তাঁর দাদির কাছে থেকে। গতবছর আশপাশের বাড়ির লোকজনকে অল্প-অল্প করে খাইয়ে বেশুমার প্রশংসাও পেয়েছেন, ফলে প্রচ্ছন্ন লোভ বেড়ে গেছে হয়তো। কাজেই এ-বছর আরো জলপাইয়ের প্রয়োজন। গাছে ফলেছেও মন্দ নয়। জলপাই পাড়তে গাছে তুলে দেওয়া হয়েছিলো বাড়ির শক্তপোক্ত কাজের ছেলেটাকে। তার সুতীক্ষ্ম চোখজোড়া এড়িয়ে, পাতার ভাঁজে থেকে কিভাবে যেন বেঁচে গিয়েছিলো আমাদের জলপাইটাও। নয়তো সেটিও বাকিদের মতো ক্রমাগত খোঁচায় জর্জরিত হতো, তারপর প্রচণ্ড তাপে সমাপ্তি ঘটতো তার অকিঞ্চিৎকর জলপাই-জীবনের। তা অবশ্য হয়নি। বাঁচোয়া।

তবু শেষরক্ষা হলো কি? গাছে এখনো অনেক জলপাই—তাতে চোখ পড়েছে কয়েকবাড়ি পরের ভীমাকৃতি ছেলেটির আর তার দলবলের। ওরা আসবে মাঝদুপুরে, পা টিপে টিপে। ফলভর্তি একটা শাখায় অনেক জোরে ঝাঁকি দিয়ে, ধুপধাপ যতোটা পারা যায় কুড়িয়ে নিয়ে চম্পট দেবে ওরা। পুরো ব্যাপারটা হবে খুব দ্রুত, কারণ কখন কে এসে পড়ে! ফলে দিগ্বিদিকশূন্য হয়ে কুড়োনোর সময় আমাদের ওই জলপাইটিও তাদের হস্তগত হতেই পারতো। অত বাছবিছার করার সময় তো নেই। তারপর হাঁপাতে হাঁপাতে ওরা যাবে প্রাচীরে ঘেরা একটা নির্জন বাগানে, সেখানে কাঁচা জলপাইগুলো ওদের চালান হবে, হয়তো কাগজের ভাঁজে আনা লবণ আর কাঁচামরিচের সঙ্গে। আন্দাজের ভুলে ঝাল হয়তো একটু বেশিই হবে। তখন হুস হুস শব্দ হবে খুব।

শেষ পর্যন্ত ঠিক কী ঘটেছিলো—লেখক বা আমি, কেউই তা জানি না। তবে আমরা দুজনই জলপাইটিকে এখনো ভূশয্যাগত দেখতে পাচ্ছি। অর্থাৎ সম্ভাব্য সকল বিপত্তি এড়িয়ে সে দিব্যি টিকে গেছে। শীতের বিকেল। সূর্যের ম্রিয়মাণ আঁচ পড়েছে জলপাইটার গায়ের একদিকে। উৎসচ্যুত হওয়ার আক্ষেপে এবং ধুলোয় গড়াগড়ি খেতে খেতে তাকে কিছুটা বিবর্ণ-বিমর্ষ দেখায়। পাশে একটি কালোরঙের মুর্গি তার একসপ্তাহ বয়সী রেশমের মতো ছানাদের নিয়ে ময়লা খুঁটছে। একটা ছানা কী ভেবে জলপাইটার ওপরে উঠে বসে, যেন বুনো পশ্চিমের ঘোড়সওয়ার সে। জলপাইটি তীব্র প্রতিবাদ করে, সামান্য ঘুরে যায়। ছানাটি আত্মরক্ষার তাগিদে লাফ দিয়ে সরে আসে। খানিকটা বিস্ময়ে, অবিশ্বাসে।

মাথা উঁচিয়ে ছয়টি কী সাতটি সূর্যোদয় দেখে জলপাইটি, তারপর ক্রমশ মাটিতে তলিয়ে যায়। নশ্বর দেহ পচেগলে নিঃশেষ হয়। লেখক ও আমার মন ভার হয়ে আসে।

পাঠকের জন্য গল্প এখানেই শেষ। তবে লেখকের কাজ এখনো বাকি—ফলে আমারও। লেখক করুণভাবে বলেন, ‘ভায়া, আমার আর মুক্তি হলো না।’ হেসে বলি, ‘বলুন, আমাদের মুক্তি হলো না। আপনাকে আমি ছাড়ছি না।’

‘তাহলে এগোই?’

‘বিলক্ষণ।’

লেখক কিছুক্ষণ চিন্তাভাবনা করে বলেন, ‘আমাদের গল্পের অভিমানিনী জলপাইটি থেকে যে-গাছ জন্মাবে, সেটি থেকে আচার বানাবে অন্য কোনো গৃহকর্ত্রী।’

‘চমৎকার! শুকোতে দেওয়া জলপাইয়ের আচারে মুখ দেবে অন্য কোনো বাড়ির হলদে বেড়াল, যে-ই বাড়ির তিন বছরের মেয়েটা একদিন বড়ো পুকুরটায় ডুবে মরে যাবে ফট করে।’

‘একদিন ঝুমবৃষ্টিতে তেমাথার সাদারঙের বাড়িরটার সেজোছেলে তার বাপের ওপর রাগ করে ঘরছাড়া হয়ে সেই পুকুরের পাড় ঘেঁষে যাবে শহরের দিকে, সেখানে ছোট্টো একটা মেসবাড়িতে থাকতে শুরু করবে।’ চমৎকার একটি প্লটকে খাবলা দিয়ে ধরে ফেলার পরিতৃপ্তিতে লেখক চোখ বুজে ফেলেন।

‘তারপর ধরুন—সেই মেসের তেতলার মধ্যবয়সী লোকটা জুয়ার আসরে সবকিছু খুইয়ে বাড়ি ফিরবে।’

‘জুয়া খেলতে পুলিশের একজন এসআই আসে না প্রতিদিন?’ লেখক জিজ্ঞেস করেন।

‘জুয়েলের কথা বলছেন? যার একটা গোপন প্রেমিকা আছে? মেয়েটাকে একটা ভাড়াবাড়িতে এনে রেখেছে?’ আমি মনে করার চেষ্টা করি।

‘হ্যাঁ হ্যাঁ, সে-ই। শম্পা নাম মেয়েটার। শম্পা ইদানিং জুয়েলের বাড়িতে যেতে জোরাজুরি করছে, কিন্তু জুয়েল শম্পাকে ঘোরাচ্ছে।’

‘নিয়ে গেলেই পারে।’

‘আরে ভাই, আপনি সব ভুলে বসে আছেন। জুয়েলের তো বউ-বাচ্চা আছে, কিভাবে আরেকটা বিয়ে করবে?’

’হ্যাঁ, তাই তো! জুয়েলের বড়ো মেয়েটার বয়সই তো বোধহয় পনেরো-কী-ষোলো! কাজী সাজিয়ে নকল বিয়ে করে রেখেছে। আর এই শম্পা মেয়েটা এমন গাধা—ধরতেও পারেনি।’

‘তাছাড়া এর ভেতরে একটা ট্র্যাজিক ব্যাপারও আছে। জুয়েল মেয়েটাকে দুবার গর্ভপাত করিয়েছে।‘ আমরা দুজনই খানিকক্ষণ চুপ হয়ে যাই। লেখক নীরবতা ভেঙ্গে মৃদুকণ্ঠে বলেন, ‘মাসতিনেক পর মেয়েটা আরেকবার কনসিভ করবে, তখনো করাবে।’

‘ইস, ছিঃ ছিঃ! একেবারে অমানুষ একটা।’ শিউরে উঠি আমি।

‘তা হোক, কিন্তু অমানুষ-টমানুষ এসব কথা আবার গল্পে আনা ঠিক হবে না।’ লেখক গম্ভীরভাবে বলেন, ‘গল্পে নিজেদের ইনভলভড হওয়া যাবে না কিছুতেই।’

সম্বিৎ ফিরে পেয়ে বলি, ‘ঠিক, একদম ঠিক। এজন্যই আপনাকে এত ভালো লাগে আমার।’

‘মেয়েটা যে-বাড়িতে ভাড়া থাকে, তার ঠিক পাশের বাসার ছেলেমেয়েদুটিকে দেখুন। বিয়ের দু’বছর হয়েছে, কিন্তু এখনো একজন আরেকজনকে কেমন গভীরভাবে ভালোবাসে! এখানে সাত-আট পাতা লেখা যেতে পারে।’

আমি বিরক্তিভরে বলি, ‘ওসব ন্যাকামো একদম চলবে না। সম্পর্কে ফাটল ধরাতে হবে, নাহলে গল্পটা জমছে না। মেয়েটির স্খলনের একটা বিশ্বাসযোগ্য আইডিয়া এসেছে আমার মাথায়।’

লেখক একটু পিছিয়ে যান, ভয়ার্ত গলায় বলেন, ‘আমি পারবো না!’

‘আপনি নিজেই এইমাত্র বললেন, নিজেদের সম্পৃক্ত হওয়া চলবে না। ওসব ছাড়ুন।’

লেখক বিব্রতভাবে বলেন, ‘এবার ব্যতিক্রম করা যায় না? আসলে এই চরিত্রদুটির ব্যাপারে আমি, ইয়ে, একটু দুর্বল হয়ে পড়েছি।’

‘ইয়ার্কি হচ্ছে? একদম চালাকি নয়। যা বলবো, ঠিক তা-ই লিখতে হবে!’ হিংস্রভাবে বলি।

লেখক বোধহয় ইদানিং আমায় ভয় পেতে শুরু করেছেন। কাঁপতে কাঁপতে চমৎকার প্রেমের সম্পর্কটিকে তিনি চুরমার করে ফেলেন মাত্র দেড়পৃষ্ঠায়। দেখে আমি হাসি—পরিতৃপ্তির হাসি।

এরপর, এরপর?

এরপর দুজন মিলে উন্মাদের মতো এগোই। অজস্র বিচ্ছেদ, অবিশ্বাস, ব্যর্থতা, প্রতারণা, বিষাদে একের পর এক চরিত্রকে পৃথিবীতেই নরকদর্শন করাতে থাকি আমরা। তবু কি কুলিয়ে উঠতে পারি? ওদিকে যে মহাকালকে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে গল্পরাও আমাদের সমান্তরালে রাক্ষুসে গতিতে বয়ে যায় অনন্তকাল ধরে—প্রাণপণ চেষ্টাতেও কোনোটিই পুরোপুরি ধরতে পারি না যেন, প্রতিবারই পিছলে বেরিয়ে যায় কীভাবে কীভাবে। এই অদ্ভুত প্রতিযোগিতার মোহাচ্ছন্নতায় আবিষ্ট আমরা অনুভূতিশূন্য হয়ে পড়ি ক্রমশ। দিন নেই রাত নেই—অনুজীবের মতো বাতাসে গল্পরা ভেসে বেড়ায়, উড়তে থাকে রঙবেরঙের অসংখ্য জলপাই।

১৬ জুলাই, ২০১৫
মাস্টারদা সূর্য‌ সেন হল

Share this with others

Leave A Comment

About the Post
Related Posts