
প্যারিস প্রথম কিস্তি: জার্মানি হয়ে প্যারিসের পথে
প্যারিস সম্পর্কে প্রথম জেনেছিলাম অন্নদাশঙ্কর রায়ের পারী থেকে—মাধ্যমিক শ্রেণিতে আমাদের পাঠ্য ছিলো। অন্নদাশঙ্কর তাঁর বারো বছর বয়সে প্রমথ চৌধুরীর লেখা চার-ইয়ারি কথা পড়েন। বইটা পড়ে তাঁর ইউরোপ ভ্রমণের অভিলাষ সুতীব্র হয়। পরে ১৯২৭ সালে ভারতীয় সিভিল সার্ভিসের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হলে শিক্ষানবিশ হিসেবে দুই বছরের জন্য ইউরোপে যাবার সুযোগ হয় তার। এই সময়কার অভিজ্ঞতা নিয়ে তাঁর লেখাগুলো প্রকাশিত হয় বিচিত্রা পত্রিকায়, পরে যা পরিমার্জিত হয়ে বই হিসেবে ছাপানো হয় ১৯৩১ সালে। বইয়ের নাম পথে প্রবাসে। বইটির ভূমিকা আবার লিখে দিয়েছিলেন খোদ প্রমথ চৌধুরী। বোধহয় একেই বলে জীবনচক্র! প্রমথ চৌধুরী অকুণ্ঠভাবে পথে প্রবাসের প্রশংসা করেছেন তাঁর ভূমিকায়, আর বলেছেন যে—এটি একটি “বিশুদ্ধ ও উৎকৃষ্ট ভ্রমণকাহিনী”। পারী এই বইয়েরই অংশবিশেষ।
অন্নদাশঙ্কর লেখাটা শুরু করেছিলেন এভাবে—
ফরাসীদের পারী নগরীর নামে পৃথিবীসুদ্ধ লোক মায়াপুরীর স্বপ্ন দেখে। আরব্য রজনীর বোগ্দাদ্ আর কথাসাহিত্যের পারী উভয়েরই সম্বন্ধে বলা চলে, “অর্ধেক নগরী তুমি অর্ধেক কল্পনা।” পৃথিবীর ইতিহাসে পারীর তুলনা নেই। দুই হাজার বৎসর তার বয়স, তবু চুল তার পাক্লো না। কতবার তাকে কেন্দ্র ক’রে কত দিগ্বিজয়ীর সাম্রাজ্য বিস্তৃত হলো, কতবার তার পথে পথে সাম্য মৈত্রী স্বাধীনতার রক্তগঙ্গা ছুট্ল, কত ত্যাগী ও কত ভোগী, কত জ্ঞানী ও কত কর্মী, কত রসজ্ঞ ও দুঃসাহসী, বিপ্লবে ও সৃষ্টিতে স্বাধীনতায় ও প্রেমে তাকে অমর মানবের অমরাবতী করলেন, সাহিত্যে চিত্রকলায় ভাস্কর্যে নাট্যকলায় সুগন্ধিশিল্পে পরিচ্ছদকলায় স্থাপত্য ও বাস্তুকলায় সে সভ্যজগতের শীর্ষে উঠল। পারীই তো আধুনিক সভ্যতার সত্যিকারের রাজধানী, অগ্রসরদের তপস্যাস্থল, অনুসারকদের তীর্থ। এর একটি দ্বার প্রতি দেশের কাঞ্চনবান সম্ভোগপ্রার্থীদের জন্যে খোলা, অন্য দ্বারটি প্রতিদেশের নিঃসম্বল শিল্পী ভাবুক বিদ্যার্থীদের জন্যে মুক্ত। একদিক থেকে দেখতে গেলে পারী রূপোপজীবিনী, আমেরিকান ট্যুরিস্টদের হীরা-জহরতে এর সর্বাঙ্গ বাঁধা পড়েছে, তবু জাপান অষ্ট্রেলিয়া আর্জেণ্টিনা থেকেও শৌখিন বাবুরা আসেন এর দ্বার-গোড়ায় ধর্না দিয়ে একটা চাউনি বা একটু হাসির উচ্ছিষ্ট কুড়োতে। অন্যদিক থেকে দেখতে গেলে পারী অন্নপূর্ণা, সর্বদেশের পলাতকদের আশ্রয়দাত্রী, তার জাতিবিদ্বেষ নেই, সে পোল্ রুশ্ রুমেনিয়াকেও শ্রমের বিনিময়ে অন্ন দেয়, নিগ্রোকেও শ্বেত-সেনার নায়ক করে এবং নানাদেশের যে অসংখ্য বিদ্যার্থীতে তার প্রাঙ্গণ ভরে গেছে, তাদের কত বিদ্যার্থীকে সে বিদ্যার সঙ্গে সঙ্গে জীবিকাও যোগায়। পৃথিবীর অন্য কোনো নগর দেখতে পৃথিবীর এত দেশের এত ট্যুরিস্ট্ আসে না; পারী দেখতে প্রতি বৎসর যে কয়-লক্ষ বিদেশী আসে, তাদের পনেরো আনা আমেরিকান ও ইংরেজ। আমেরিকানদের চোখে পারীই হচ্ছে ইউরোপের রাজধানী, আর ইউরোপের লোকের চোখে পারী হচ্ছে লণ্ডন ভিয়েনা বার্লিন মস্কোর চেয়েও আন্তর্জাতিক।*
ফরাসিদেশ ভ্রমণের কথা এলে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের ছবির দেশে, কবিতার দেশে-র কথা বিশেষ করে বলতেই হয়। এর খানিকটা জুড়ে যুক্তরাষ্ট্র, আর বেশিরভাগটাই ফ্রান্স ভ্রমণ নিয়ে। এ-বইতে বিশেষ করে প্যারিসের যে-বিবরণ সুনীল দিয়েছেন তার জবাব নেই। প্যারিসে পা রাখার আগে অবশ্য আমি বইটা পড়ে উঠতে পারিনি, বরং উল্টোটা হয়েছে—ফেরার পথে বিমানে বসে পড়েছি, আর আমার সবচেয়ে প্রিয় বইয়েরও একটা হয়ে উঠেছে। পড়া শেষে এর একটা রিভিউ লিখেছিলাম গুডরিডস-এ।
ভ্রমণকাহিনীর কথা যখন এলোই, তাও বাংলা ভাষায়—সৈয়দ মুজতবা আলীকে এড়াবার দুঃসাধ্য আমার নেই। ভ্রমণ আর রম্যের অসামান্য যুগলবন্দী করতে পারেন সেরকম নমস্যপুরুষ বাংলা ভাষায় আমাদের এই একজনই ছিলেন। দেশে বিদেশে-র পর যদি তিনি আর বিশেষ কিছু না-ও লিখতেন তবু তাঁর মাহাত্ম্য ক্ষুণ্ণ হতো না। অবশ্য পাঠকদের ওপরে তিনি অতটা অপ্রসন্ন হননি। দুহাতে লিখেছেন। ফ্রান্স নিয়ে আলাদাভাবে বই লেখেননি অবশ্য, তবে পঞ্চতন্ত্রে প্যারিস নামে একটা লেখা রয়েছে। সেটায় অবশ্য প্যারিস নয়, সেখানকার মেয়েদের কথাই প্রাধান্য পেয়েছে। অবশ্য ভুয়োদর্শী লোক তো—কে জানে হয়তো বুঝেশুনেই ওরকম করেছেন। মেয়েদের দিয়েই সত্যিকারের দিগ্দর্শন হয় কিনা!
যা বলছিলাম। অন্নদাশঙ্কর রায়ের বর্ণনার হাতটিও বড়ো খাসা। এমনিতে বাংলা ভাষায় সার্থক ভ্রমণকাহিনী লেখা হয়নি খুব বেশি। আর এখনকার দিনে ভালো ভ্রমণকাহিনী তো আরও দুষ্প্রাপ্য হয়ে উঠেছে। অবশ্য যুগধর্মের একটা প্রভাব তো থাকেই। ভ্রমণ সম্ভবত এই সময়ে এসে অনেকটাই ছবি তোলা আর রিলস বানানোতে সীমাবদ্ধ হয়ে পড়েছে। ফলে একটা চিত্রকর্ম উপভোগ করা কিংবা গল্পটাকে অনুধাবন করার চেয়ে চেকইন কিংবা ভালো অ্যাঙ্গেলে সেটার কিছু স্ন্যাপ নিতে পারাটাই বেশি গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু আমার কাছে সত্যিকার ভ্রমণ বলতে যা বোঝায়—তা হলো একটা বস্তুকে নিংড়ে উপভোগ করা, নিজের চোখজোড়াকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেয়া, ভ্রমণের আগে-পরে দেশ-শহর-সমাজের ইতিহাস-ঐতিহ্য-সংস্কৃতিকে বুঝতে চেষ্টা করা। আর তারচেয়েও বড়ো প্রয়োজন মানুষকে দেখা—কারণ চারিদিকে রয়েছে বিচিত্র বর্ণিল লক্ষ লক্ষ মানুষ। মানুষ দেখতে জানলে তা কখনো একঘেয়ে হয় না। যোগাযোগব্যবস্থার অভাবনীয় উন্নতির ফলে ঘুরতে যাওয়া যতো সহজ হয়ে উঠছে, ভ্রমণ ঠিক ততোটাই দুর্লভ হয়ে পড়েছে—ফলে ভালো ভ্রমণসাহিত্যও হয়ে উঠেছে দুষ্প্রাপ্য।
একটা ইন্টার্নশিপ করতে মাসদুয়েকের জন্য ফিনল্যান্ড থেকে প্যারিসে গিয়েছিলাম ২০২৩ সালের সামারে। যাওয়ার প্রাক্কালে সহপাঠী ও শুভানুধ্যায়ীদের আগে প্যারিস সম্পর্কে যা-কিছু শুনেছি তার বেশিরভাগই সতর্কবাণী—ফোন সাবধান, মানিব্যাগ সাবধান! মনে হচ্ছিলো যেন প্যারিসে নয়, গুলিস্তানে যাচ্ছি। অবশ্য যাওয়ার পর এই সতর্কতার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করি হাড়ে হাড়ে।
ইন্টার্নশিপের চুক্তিটুক্তি স্বাক্ষর করে ফেললাম ২০২৩ সালের জুনের শুরুতে। যোগদান জুলাইয়ের প্রথম সপ্তাহে, অর্থাৎ প্রস্তুতির জন্য মাসখানিকের মতো সময় হাতে। সবকিছু ঠিকই ছিলো, কিন্তু আমার ফিনিশ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইন্টার্নশিপের ফান্ড মঞ্জুর হতে খানিকটা দেরি হচ্ছিল। প্রধান সমস্যা হলো, ততদিনে ফিনল্যান্ডে গ্রীষ্মকালীন আবহ শুরু হয়ে গেছে। ইউরোপীয়রা গ্রীষ্মে কাজ করার ব্যাপারে যথেষ্ট অনীহ। তার ওপরে দেশটা ফিনল্যান্ড। বছরের প্রায় তিন-চতুর্থাংশ জুড়েই তীব্র শীত বলেই বোধহয় গ্রীষ্মকালের মর্ম ওরা জানে। আবহাওয়া খানিকটা উষ্ণ হতে-না-হতেই সবার মাঝে ছুটির আমেজ চলে আসে, পুরো শীতজুড়ে গমগম করতে থাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস প্রায় মৃত্যুপুরীতে পরিণত হয়। দুচারজনের বেশি শিক্ষক-শিক্ষার্থী চোখে পড়ে না, লবিতে মানুষজন নেই, ভিড়ের জন্য যেখানে মধাহ্নভোজের সময় বসার জায়গা পাওয়া যেত না—সেই ক্যাফেগুলো পর্যন্ত বন্ধ। স্বভাবতই প্রশাসনিক কার্যক্রমও তখন চলছে ঢিমেতালে। কিন্তু ফান্ডটা নিশ্চিত না হলে টিকিট করতেও ভরসা পাচ্ছিলাম না। হেলসিঙ্কি থেকে প্যারিস যাতায়াতের বিমানভাড়া একেবারে কম নয়। আগেভাগে কাটার পর সেটা গচ্চা গেলে সমূহ বিপদ। উদ্বিগ্নভাবে কিছুদিন অপেক্ষা করলাম, বেশকিছু ইমেইল চালাচালি হলো। অবশেষে ইন্টারন্যাশনাল অফিস থেকে সবুজ বার্তা পাওয়া গেলো।
আহ্, প্যারিস! যাওয়া হচ্ছে তাহলে।
জুনের শেষদিকে যখন ফান্ড নিশ্চিত হলো, তখনই আমি টিকিট খুঁজতে লেগে পড়লাম। ইতোমধ্যে অনেক দেরি হয়ে গেছে, সরাসরি ফ্লাইটের দাম বেড়ে গেছে। ট্রানজিট নিয়ে খরচ কমানো যায় কিনা ভাবতে ভাবতেই জার্মানি যাওয়ার কথা মাথায় এলো। ফ্রান্সের পাশেই জার্মানি। জার্মানি যেতে পারলে সেখান থেকে দ্রুতগতির ট্রেনে প্যারিস চলে যাওয়া যাবে। এমনিতেও জার্মানি যাওয়ার কথাবার্তা হচ্ছিলো কিছুদিন ধরেই। স্কুলজীবনের খুব কাছের বন্ধু লিয়ন থাকে সেখানে। তাছাড়া কয়েকদিন পরই ঈদুল আজহা। ঈদ নিয়ে আমার ভাবাবেগ অবশ্য ততোদিনে কমে গেছে, তারপরও ভাবলাম—ঈদের দিনটা জার্মানিতে কাটিয়ে, একটু ঘুরেফিরে এরপর প্যারিস যাওয়া যায় কিনা? একটু ঘুরপথ হবে অবশ্য, কিন্তু এর ফলে অনেকগুলো নতুন নতুন জায়গা দেখা হবে। শেষমেষ টিকিট করলাম হেলসিঙ্কি থেকে ফ্রাঙ্কফুর্টেরই। ফ্লাইট ঈদের দিন ভোরবেলায়, এয়ারবাল্টিকে। এটাও সরাসরি নয় অবশ্য। মাঝখানে লাটভিয়ার রিগা এয়ারপোর্টে ঘন্টাদেড়েকের ছোটো একটা লেওভার আছে। তাতে কোনো অসুবিধা ছিলো না, তবে যখন ফ্রাঙ্কফুর্ট পৌঁছাবো, ততক্ষণে সেখানে ঈদের নামাজ শেষ হয়ে যাবে। বিদেশে আসার পর এ-নিয়ে দুটো ঈদ হচ্ছে। নামাজ ধরতে পারিনি গত ঈদেও। ঈদুল ফিতরের দিনে একটা অ্যাকাডেমিক পরিদর্শনের কাজে ফিনল্যান্ডের হাইলুয়োতো দ্বীপে গিয়েছিলাম। ভ্রমণটা অবশ্য বেশ উপভোগ্যই ছিলো, তবে ঈদের নামাজে না যেতে পারলে মনটা একটু খুঁতখুঁত করে। অনেককালের অভ্যাস তো! যাইহোক।
হেলসিঙ্কি থেকে আমার ফ্লাইট ছিলো ভোর সাড়ে পাঁচটায়। অর্থাৎ আগেভাগে হেলসিঙ্কি এয়ারপোর্টে গিয়ে বসে থাকতে হবে। এটা একটা ঝামেলাই। হিসেবনিকেশ করে অউলু থেকে প্রায় ঘন্টাসাতেকের রেলভ্রমণ শেষে হেলসিঙ্কি পৌঁছলাম রাত বারোটায়। এয়ারপোর্টে ঘণ্টাপাঁচেক বসে থাকতে অবশ্য খুব খারাপ লাগেনি। ইউরোপের বিমানবন্দরগুলোতে অনেকেই রাত কাটায়, বিশেষ করে বাজেট ট্র্যাভেলার বা ব্যাকপ্যাকাররা। মানুষজনের ভিড়ের মাঝে তারা দিব্যি হাত-পা ছড়িয়ে ঘুমায়। আমি অবশ্য ঘুমাইনি। একটু পড়তে-পড়তে আর ল্যাপটপে লিখতে-লিখতেই অনবোর্ডিং-এর সময় হয়ে গিয়েছিল।
যাত্রার ঘণ্টাখানিক পরই পৌঁছে গেলাম লাটভিয়ার রিগা বিমানবন্দরে। মাত্র দেড়ঘণ্টার বিরতি, অর্থাৎ বাইরে যাওয়ার প্রশ্নই ওঠে না। খুবই ছোটো এয়ারপোর্ট। তেমন জাঁকজমক নেই, ভিড়ও নেই। তবে গোছানো। এয়ারবাল্টিক মূলত লাটভিয়ার পতাকাবাহী উড়োজাহাজ, অর্থাৎ রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান। এজন্য এদের কানেক্টিং ফ্লাইটগুলোর ট্র্যানজিট হয় রিগাতে। ইউরোপের অনেক রুটেই এয়ারবাল্টিকের ফ্লাইট আছে। এয়ারলাইন্সগুলো ইকোনমি শ্রেণির টিকিটগুলোর খরচ কিছুটা কমিয়ে রাখার চেষ্টা করে। এজন্য সাধারণত খাবারটাবার দেয় না। খুব বেশি হলে পানি বা ব্লুবেরি জুস দিতে পারে। এজন্য রিগায় নেমে সকালের জলখাবার সেরে নিলাম, কারণ পরের ফ্লাইট কিছুটা দীর্ঘ। এসব করতে করতে কানেক্টিং ফ্লাইটের সময় হয়ে এলো। আগেই বলেছি, রাতে ঘুমাইনি। এর খেসারতও দিলাম। রিগা থেকে ফ্রাঙ্কফুর্ট গেলাম প্রায় পুরোটাই ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে—অর্থাৎ উইন্ডো সিট পেয়েও কোনো লাভ হলো না। স্থানীয় সময় আনুমানিক ৯টার দিকে ফ্রাঙ্কফুর্ট এয়ারপোর্টে নামলাম। জার্মানির ব্যস্ততম বিমানবন্দর। চারিদিকে মানুষের আধিক্য আর তাড়াহুড়ো চোখে পড়ার মতো।
আমাকে নিতে লিয়ন কিছু প্রবাস-বন্ধুসহ বিমানবন্দরে এসেছিলো। ব্যক্তিগত গাড়িতে করে যেতে যেতে সবিস্ময়ে ফ্রাঙ্কফুর্ট দেখি। ফিনল্যান্ডে আসার প্রায় মাসছয়েক হয়েছে ততদিনে, তবে অউলুর বাইরে কোনো শহর দেখার সুযোগ হয়নি। জার্মানির মতো ধনী দেশের জাঁকজমকের সঙ্গে ফিনল্যান্ডের তুলনা হয় না, ফলে পার্থক্যটা চোখে পড়ে। আবহাওয়াও একটা বড়ো ব্যাপার। পুরো শীতকালজুড়ে ফিনল্যান্ডে এত বেশি তুষার, অন্ধকার আর ঠাণ্ডা সইতে সইতে অতিষ্ঠ হয়ে গিয়েছিলাম। ওসবেরও একটা সৌন্দর্য আছে, তবে মাত্রাহীন হয়ে পড়লে বিপদ। মাঝে মাঝে তো এমনও মনে হতো যে পৃথিবীতে সাদা আর ধূসরের বাইরে কোনো রঙের অস্তিত্ব নেই। গ্রীষ্মের শুরুতে রঙিন ফিনল্যান্ডকে খানিকটা দেখে এসেছিলাম অবশ্য। সেখানে তখন গাছে নতুন পাতা আসছে, ফুলটুল ফুটছে।
ফ্রাঙ্কফুর্ট ভালো লাগলো আমার। লিয়নের বাসাটা শহরের একটু বাইরে, তবে আমার এরকম পরিবেশই পছন্দের। দশতলা ভবনটাতে ছোটো ছোটো অনেকগুলো অপরিসর ঘর, সঙ্গে শেয়ার্ড রান্নাঘর আর বাথরুম। ভাড়াও খুব বেশি নয়। একা মানুষের থাকার জন্য যথাযথ বলা যায়। রান্নাবান্নার জন্য লিয়নের আগে থেকেই সুখ্যাতি ছিলো, এখানে এসেও সেই গুণের ভালো কদর হয়েছে দেখলাম। ঈদের আমেজ তৈরি হলো দুপুরে, যখন লিয়নের পরিচিত মানুষজন এলো, আর মধ্যাহ্নভোজে পাতে উঠলো সুস্বাদু অনেকগুলো বাংলাদেশি পদ। সবাই মিলে ঘুরতে বেরোলাম বিকেলে। চমৎকার গণপরিবহন ব্যবস্থা—বাস, মেট্রো, ট্রাম। ডে-টিকিটের দৈনিক খরচ ৬ ইউরোর মতো, এই টিকিটে যেকোনো যানবাহন যতোবার ইচ্ছে ব্যবহার করা যায়। বিকেলে ট্রামে চেপে গেলাম ফ্রাঙ্কফুর্টের বিখ্যাত মাইন নদীর ধারে, যার পাশেই সুউচ্চ ইউরোপিয়ান সেন্ট্রাল ব্যাঙ্ক। ফ্রাঙ্কফুর্ট শহরের দাপ্তরিক নাম Frankfurt am Main, অর্থাৎ নামই বলছে—এটি মাইন নদীর পাড়ের শহর। নদী সবসময়ই মানব-ইতিহাসের কেন্দ্রবিন্দু ছিলো, এমনকি আজও। এজন্যই দেখা যায় ঐতিহ্যবাহী বড়ো বড়ো শহরগুলো নদীতটে অবস্থিত। খাওয়ার জল থেকে শুরু করে সেচ, যাতায়াত—সবকিছুতেই সর্বযুগে নদীর ভূমিকা ছিলো অতুলনীয়। বুড়িগঙ্গার মতো চমৎকার একটি নদী আমাদেরও ছিলো, অযত্নে-অবহেলায় যা পরিণত হয়েছে নিকৃষ্ট ভাগাড়ে। নদীকে ঘিরে মানবসভ্যতা গড়ে উঠেছে, সেসব ক্রমশ শক্তিশালী হয়েছে, এমনকি একসময় অনেক সভ্যতা-ধ্বংসের কারণও হয়েছে নদীর বাঁকবদল বা পরিবর্তন। সিন্ধুনদের পাড়ে খরা দেখা দিলে ক্রমশ বিলীন হতে হয়েছে সিন্ধু সভ্যতাকে, খরার কারণে শেষ হয়ে গেছে শক্তিশালী মায়ান সভ্যতাও। এরকম অজস্র উদাহরণ থাকার পরও এই সময়ে এসে তর্ক করতে হয়—ইয়েস, ইনডিড, ক্লাইমেট চেঞ্জ ইজ রিয়েল। সত্যিই অদ্ভুত।
মাইন নদীতীরের ফুরফুরে হাওয়া আর স্নিগ্ধ পরিবেশে মন ভালো হয়ে গেল। পানিতে বিভিন্ন আকারের জলযান চলছে, এমনকি বিশালাকারেরও কয়েকটিকে দেখা গেলো। অর্থাৎ গভীরতা ভালোই। চওড়ায় অবশ্য অতটা নয়, লিয়নের বন্ধুবান্ধবদের কথা বিশেষ করে বলতেই হয়। এদের ভেতরে তিনটি দম্পতিও ছিলো। খুবই অমায়িক আর হাসিখুশি মানুষজন সবাই। বাড়তি পাওনা হিসেবে রাতে নিমন্ত্রণ ছিলো শহরের উপকণ্ঠে বসবাসরত এদেরই ঘনিষ্ঠ একটি অতিথিপরায়ণ বাঙালি পরিবারে। নিতান্ত অপরিচিত মানুষ হওয়া সত্ত্বেও আমি উষ্ণ আতিথেয়তা পেলাম। সবমিলিয়ে ঈদের দিনটি ঈদের মতোই কাটলো বললে অত্যুক্তি হবে না।
এরপরের দুদিন ফ্রাঙ্কফুর্টেরই বিভিন্ন অংশে ঘোরাঘুরি হলো, শুধু আমি আর লিয়ন মিলে। ফ্রাঙ্কফুর্ট নিয়ে আমার সবচেয়ে আকর্ষণ ছিলো এর বইমেলাকে ঘিরে। ছোটোবেলায় জেনেছিলাম—এটাই পৃথিবীর সবচেয়ে বড়ো বইমেলা। দুঃখের বিষয়, তখন বইমেলার সময় নয়। তবে সেটা বাদ দিয়েও যা দেখলাম মন্দ নয়। এর মধ্যে অন্যতম বেথমান পার্ক। পার্কটি স্থাপিত হয়েছিলো ১৭৮৩ সালে। তবে পুরো ফ্রাঙ্কফুর্ট শহরটাই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ধ্বসে গিয়েছিলো এবং নতুন করে সবকিছু আবার করতে হয়েছে। ফলে এই পার্কটিও তার আদিরূপে নেই। এর একটি অংশবিশেষ এশীয় থিমে গড়া। কাঠের ছোটো সেতু, জলাধার, মাছ, হাঁস, দৃষ্টিনন্দন মিনিমালিস্ট কাঠামো আর প্রচুর গাছপালায় ঢাকা পার্কটা সত্যিই শান্তির অনুভূতি জাগায়। লেখালিখি বা চিন্তাভাবনা জন্য আদর্শ পরিবেশ বলা যায়। পরদিন দেখা হলো গ্যেটে বিশ্ববিদ্যালয়। ফ্রাঙ্কফুর্ট প্রখ্যাত জার্মান কবি ও নাট্যকার গ্যেটের শহর। এজন্য এই বিশ্ববিদ্যালয়ও তাঁর নামেই করা। নিজের বিশ্ববিদ্যালয়ের বাইরে এটি আমার দেখা দ্বিতীয় কোনো ইউরোপীয় বিশ্ববিদ্যালয়। ১৯১৪ সালে স্থাপিত বিশ্ববিদ্যালয়টিতে নোবেল লরিয়েটের সংখ্যা ১৯। অবচেতনভাবেই ভেবে ফেলি যে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ও এরই সমসাময়িক—অথচ পার্থক্যটা আজ কতোই না প্রকট! অবশ্য বিশ্ববিদ্যালয় তো আর সমাজবিচ্ছিন্ন কিছু নয়; ক্ষয়িষ্ণু সমাজের বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বেশিকিছু আশা করাই অন্যায়। যাইহোক, গ্যেটে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশাল ক্যাম্পাস আর প্রাণোচ্ছল পরিবেশ দেখে ভালো লাগলো। অনেকে লাইব্রেরির বইতে মুখ গুঁজে পড়ছে, অনেকে আবার বাইরের ক্যাফের সামনে দলবেঁধে আড্ডা দিচ্ছে বিয়ারের বোতলহাতে। বহুভাষিকতার থিম নিয়ে তৈরি একটি নামকরা ভাস্কর্যও দেখলাম সেখানে, যদিও অনেক খুঁজেও আমরা তাতে বাংলাভাষা পেলাম না। পরে যাওয়া হলো সিটি সেন্টারে। ইউরোপীয় শহর হিসেবে এর আগে কেবল দেখেছি ফিনল্যান্ডের অউলুকে, যেখানে সিটি সেন্টার খুবই ছোটো, কয়েক পা হাঁটলেই শেষ। ফলে ফ্রাঙ্কফুর্ট আমাকে বিস্মিত করলো। প্রচুর মানুষ, অজস্র রেস্তোরাঁ, শপিংমল আর দোকানপাট, কনসার্ট, অপেরা ইত্যাদি দিয়ে পুরো অঞ্চল গমগম করছে। গ্যেটের একটি চমৎকার ভাস্কর্যও ছিলো সেখানটায়। সেদিন রাতেও মাইন নদীর পাড় ধরে অনেকক্ষণ হাঁটাহাঁটি করলাম। এত ব্যস্ত শহর, এত মানুষ, এত আলো, তবু সবকিছু কতো স্নিগ্ধ।
তবে জার্মানি ভ্রমণের সবচেয়ে আকর্ষণীয় অংশটি তখনো আমার জন্য অপেক্ষা করছিলো। হাইডেলবার্গ! অবশ্য এর কৃতিত্ব লিয়ন আর তার বন্ধুদের। কাছেপিঠে কোথায় যাওয়া যায়—সেই আলাপ করতে করতেই হাইডেলবার্গের কথা এসেছিল। নামের মধ্যেই কেমন একটা মোহ আছে। খুব দূরেও নয়, ফ্রাঙ্কফুর্ট থেকে মাত্র নব্বই কিলোমিটার। পয়লা জুলাই সকাল-সকাল আমরা ব্যক্তিগত গাড়িতে হাইডেলবার্গ রওনা হলাম। যেতে-যেতেই জানলাম যে জার্মানির শহরের বাইরের প্রধান সড়কগুলোতে (অর্থাৎ autobahn) কোনো ঊর্ধ্ব গতিসীমা নেই। ফলে বিস্মিত হয়ে দেখলাম গাড়ি প্রায় আক্ষরিক অর্থেই উড়ে চললো। মাত্র চল্লিশ কী পঞ্চাশ মিনিটে হাইডেলবার্গ!
ছবির মতো সুন্দর, এই কথাটাকে এতদিন আমার কাছে অতিশয়োক্তি মনে হতো। কিন্তু হাইডেলবার্গকে কি এরচেয়ে ভালোভাবে বর্ণনা করা সম্ভব!
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জার্মানির বেশিরভাগ শহরের ওপরেই মিত্রশক্তি নির্বিচারে বোমাবর্ষণ করেছিলো। তবে ব্যতিক্রম হাইডেলবার্গ। শত্রুরা কেন হাইডেলবার্গ আক্রমণ করেনি তা নিয়ে অনেক জনশ্রুতি আছে, তবে এর কোনোটিই ঐতিহাসিকভাবে প্রমাণিত নয়। অনেকে বলেন, এত সুন্দর শহরকে তারা নষ্ট করতে চায়নি—যদিও এটি খুব নির্ভরযোগ্য হাইপোথিসিস নয়। যুদ্ধক্ষেত্রে আবেগিক সিদ্ধান্ত নেওয়ার খুব বেশি সুযোগ থাকে না। যুদ্ধে জয়লাভ করার পর মার্কিন সেনারা হাইডেলবার্গে নিজেদের গ্যারিসন স্থাপন করবে বলে তারা আক্রমণ করেনি, এমন মতামতও বেশ জনপ্রিয়—কিন্তু সেটিরও তেমন তথ্যপ্রমাণ নেই। সবচেয়ে যুক্তিযুক্ত ব্যাখ্যা সম্ভবত এটিই যে—হাইডেলবার্গ তখন ভৌগলিক বা সামরিক দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ ছিলো না, ফলে অনর্থক আক্রমণেরও প্রয়োজন পড়েনি। কারণ যেটাই হোক না কেন, হাইডেলবার্গ যে বেঁচে গেছে সেটাই আসল কথা।
হাইডেলবার্গকে খুব ভালোভাবে দেখার জন্য সেরা স্থান Königstuhl, যা পাহাড়ের একদম চূড়ার দিকে। প্যাঁচানো খাড়া রাস্তায় উঠতে হয়। পায়ে হেঁটে ওঠা-নামার জন্য হাইকিং ট্রেইলও আছে। এছাড়াও আছে ফার্নিকুলার রেলওয়ে। ট্রেনে করে শহর থেকে সরাসরি এই পয়েন্টটাতে চলে আসা যায়। আমরা অবশ্য ব্যক্তিগত গাড়িতেই চূড়ায় উঠেছিলাম। সেখান থেকে চোখের সামনে দৃশ্যমান হলো পুরো শহরটা। শুরুতেই নজর কাড়ে হাইডেলবার্গের ভেতর দিয়ে বয়ে যাওয়া অপরূপ নদী নেকার। পরে নিচে নেমে নদীটাকে আরো কাছ থেকে দেখেছি। সবমিলিয়ে চূড়ায় প্রায় ঘন্টাখানিক ছিলাম। এত চমৎকার জায়গা যে সহজে ছেড়ে আসতে ইচ্ছে করছিলো না।
নামার পর আমরা চলে যাই হাইডেলবার্গের সবচেয়ে বিখ্যাত জায়গায়—হাইডেলবার্গ রাজপ্রাসাদে। এটি নির্মিত হয়েছিলো তেরো শতকে। পরে বিভিন্ন সময়ে সংস্কার আর বর্ধনের কাজ হয়েছে। সময়াভাবে প্রাসাদের একদম ভেতরে যাওয়া হয়নি আমাদের, তবে বাইরে থেকে উপভোগ করেছি। আরো দুটি বিশেষ জায়গা দেখা বাকি ছিলো আমাদের—নেকার নদীর ওপরে হাইডেলবার্গের পুরোনো সেতু এবং হাইডেলবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়। সেতুর বিশেষত্ব হলো, এটি প্রায় আড়াইশো বছরের পুরোনো। কালক্রমে এটি হাইডেলবার্গের প্রতীকই হয়ে উঠেছে। শহরের যেকোনো স্মারক বা ছবিতে এই সেতু থাকবে। অন্যদিকে ১৩৮৬ সালে প্রতিষ্ঠিত জার্মানির সবচেয়ে পুরোনো বিশ্ববিদ্যালয়টি হাইডেলবার্গে। এই বিশ্ববিদ্যালয়ের নোবেলজয়ী অ্যালামনাই ৫০ জনেরও বেশি। আর এমনিতেও বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রখ্যাত অ্যালামনাইদের তালিকাটি সমীহজাগানিয়া—দার্শনিক হেগেল, সমাজবিজ্ঞানী ম্যাক্স ওয়েবার, পর্যায় সারণির জনক দিমিত্রি মেন্ডেলিফ, সাহিত্যিক সমারসেট মম থেকে শুরু করে এই তালিকা এখনো সমৃদ্ধ হচ্ছে প্রতিনিয়ত। দর্শনীয় শহরটির সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয় মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে। বিকেলে যখন ফ্রাঙ্কফুর্টে ফিরলাম—বুঝতে পারছিলাম যে জীবনের অন্যতম সেরা দিন কাটিয়ে এসেছি।
এত ঘোরাঘুরি করলেও একটা বিষয় আমাকে উদ্বিগ্ন করে রেখেছিলো পুরোটা সময়। ফ্রাঙ্কফুর্ট থেকে প্যারিসগামী ট্রেনে দোসরা জুলাই সকালের একটা টিকিট করে রেখেছিলাম, কারণ তিন তারিখে প্যারিসে আমার রিপোর্টিং। কিন্তু প্যারিস তখন রীতিমতো উত্তাল। আমি যেদিন জার্মানি যাই তার একদিন আগে, অর্থাৎ ২৭ জুনে ভয়াবহ কাণ্ড ঘটে গেছে সেখানে। আলজেরীয় বংশোদ্ভূত ১৭ বছর বয়সী তরুণ নাহেল মেরজুককে পুলিশ গুলি করে হত্যা করেছে, ফলশ্রুতিতে ফ্রান্সজুড়ে চলছে সহিংসতা-বিক্ষোভ। সারা পৃথিবীর চোখ তখন ফ্রান্সের ওপরে। আমার তো উপায় নেই, যেতেই হবে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন অগ্রজের সঙ্গে আগেভাগে যোগাযোগ করে রেখেছিলাম, যিনি ফ্রান্সের স্থায়ী বাসিন্দা। আমার থাকার জায়গাটিও তিনিই ঠিক করে দিয়েছিলেন। ভাবলাম, কী আর এমন হবে, যাই তো আগে!
দুই তারিখ সকাল আটটায় ফ্রাঙ্কফুর্ট কেন্দ্রীয় রেলস্টেশন থেকে ট্রেন ছাড়লো। মাঝখানে ছোটো একটা ট্রানজিট ছিলো। দ্রুতগতির আরামদায়ক ট্রেন। বাইরের দৃশ্য উপভোগ করেছি যতক্ষণ পারা যায়। মাঝখানে একটু হাঁটাহাঁটি, ট্রেনের ক্যাফেতে যাওয়া। দুদিকে প্রতিনিয়ত সরে সরে যাচ্ছিলো বিশাল উন্মুক্ত প্রান্তর, বনজঙ্গল, ছোটোবড়ো শহর। এ-সবকিছু পেরিয়ে প্যারিসের গার্দো নর্দ স্টেশনে পৌঁছে গেলাম আনুমানিক দুপুর সাড়ে বারোটার দিকে।
স্টেশন থেকে বেরিয়েই বুঝতে পারলাম হাওয়া ভালো নয়। বেশিরভাগ দোকানপাটই বন্ধ। রাস্তায় মানুষজন তেমন নেই। খবরে পড়েছিলাম, সামারের এই সময়টা ট্যুরিস্টে গিজগিজ করে প্যারিসের পথঘাট। কিন্তু এই হাঙ্গামার কারণে তারা আপাতত আসতে সাহস পাচ্ছে না।
তবু চোখ সরাতে পারি না। প্যারিস তো!
পরবর্তী খুঁটিনাটি বর্ণনায় আর যাচ্ছি না। সংক্ষেপে বলতে গেলে, পূর্বনির্ধারিত বাসায় গেলাম, প্যারিসিয়ান ট্রান্সপোর্ট সিস্টেমটা বুঝে নিয়ে একটা মান্থলি টিকিট করে ফেললাম, এরপর ওইদিন বিকেলেই ইউনেস্কো অফিসের অবস্থান এবং তার খুব কাছেই অবস্থিত আইফেল টাওয়ার দেখে এলাম। মোটামুটি এই ছিলো আমার প্রথমদিন। পরদিন সকালে ইউনেস্কোতে ইন্টার্ন হিসেবে কাজ শুরু করলাম। কাজের জায়গার বিস্তারিত বিবরণ এখানে অপ্রাসঙ্গিক।
কোথাও যাওয়ার আগে জায়গাটা নিয়ে একটু পড়ালেখা করা আর দর্শনীয় জায়গাগুলো গুগল ম্যাপে দেগে রাখার চেষ্টা করি আমি। এই সূত্রেই কিছু কিছু ব্লগ পড়েছিলাম। সেরকমই একটা ব্লগে কেউ একজন মজা করে লিখেছিলো—প্যারিসে আছে মিলিয়ন মিলিয়ন জাদুঘর, যা দেখে শেষ করা অসম্ভব। কথাটা নিছক মজাই, তবে প্রকৃত সংখ্যাটাও একেবারে কম নয়। পুরো ফ্রান্সে জাদুঘর আছে হাজারের ওপরে। অন্যান্য দর্শনীয় জায়গাগুলোকে যোগ করলে সংখ্যাটা আরো বাড়বে। শুধু প্যারিসেই মিউজিয়াম প্রায় শ’দেড়েক। অর্থাৎ প্রতিদিন একটা করে দেখতে গেলেও তাতে সময় লাগছে প্রায় মাসপাঁচেক, বাস্তবে যা অসম্ভব। প্যারিসে আমার কাজটা পূর্ণকালীন, ফলে প্রতিদিন জাদুঘর দেখে বেড়ালে চলবে না। তাছাড়া এই হিসেবেও একটা ফাঁকি আছে। যেমন কেবল লুভ্রের কথাই ধরা যাক। প্রথিতযশা লুভ্র জাদুঘরে কক্ষের সংখ্যা প্রায় চারশোরও ওপরে, আর এসব কক্ষে শোভা পাচ্ছে পঁয়ত্রিশ হাজারেরও বেশি প্রদর্শনীয় বস্তু। একটা আনুমানিক হিসেবে দেখা গেছে, এর প্রতিটায় ত্রিশ সেকেন্ড করে চোখ বুলোতে চাইলেও টানা দুশো দিন কেবল লুভ্রেই পড়ে থাকতে হবে, কার্যত যা অসম্ভব। অর্থাৎ একদিনে লুভ্র দেখে শেষ করতে চাওয়া কিংবা দশ মিনিটের ভেতরে চন্দ্রজয় করে নেমে আসার পরিকল্পনার ভেতরে বিশেষ পার্থক্য নেই। ইন্টার্নশিপের সুবাদে আমি এসেছি মোটে মাসদুয়েকের জন্য, তাছাড়া দুর্মূল্যের শহর প্যারিসে অর্থকড়িও খরচ করতে হয় খুব হিসেব করে। অর্থাৎ এবারের যাত্রায় প্যারিসের বেশিরভাগ জাদুঘরই আমার পক্ষে দেখা সম্ভব নয়। ফলে ভেবেচিন্তে বাছতে হয়েছে।
জাদুঘর দেখার একটি গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ হচ্ছে জাদুঘর দেখার আগ্রহ থাকা। বলাই বাহুল্য জাদুঘর দেখতে সবাই ভালোবাসেন না, আর সেটা দোষেরও নয়। তবে আমার ভালো লাগে। ঢাকার জাতীয় জাদুঘর আমি যতোবারই দেখেছি সমান আগ্রহে দেখেছি। পরবর্তীতে যখন আরো অনেকগুলো জাদুঘর দেখার সুযোগ হলো, বিশেষ করে বিদেশে, তখন অনুধাবন করেছি যে আমাদের জাদুঘরে পড়ে থাকা সম্পদগুলোর মূল্যমান আমরা আসলে অনুধাবনই করি না সেভাবে। আরো অনুভব করেছি যে—প্রদর্শনের মতো জিনিসের অভাব নেই আমাদের, কিন্তু সেগুলো কীভাবে প্রদর্শন করতে হবে তা আমরা জানি না। জাদুঘর হলো জ্ঞান, শিল্প ও সৃজনশীলতার সমারোহ। কিন্তু দুঃখের বিষয় হলো বাংলাদেশের জাদুঘরগুলো আপাদমস্তক আমলাতন্ত্রের অংশ। ফলে এখানে যে-কাজগুলো হয়, সেগুলো মূলত রুটিন কাজ। কারণটাও অনুমেয়। একজন প্রচণ্ড মেধাবী মানুষও বাংলাদেশের আমলাতন্ত্রের অংশ হয়ে গেলে ক্রমশ কিছু অর্থহীন নিয়মসর্বস্ব হয়ে পড়েন, আর তাঁদের ভেতরকার সৃজনশীল সত্তাটি নষ্ট হয়ে যায়, যা তাঁরা টের পান না। সবাই তো আর শহীদুল জহির নন!
যাইহোক, জাদুঘর দেখার আগ্রহ থাকলেও স্বীকার করতে কুণ্ঠা নেই যে, আমি শিল্পকলার ঝানু সমঝদার নই, শিল্পের ইতিহাস অল্প-অল্প জানি, কিছু বিখ্যাত শিল্পীকে চিনি, এটুকুই। কিন্তু প্যারিসের বেশিরভাগ জাদুঘরই আবার শিল্পকর্ম-কেন্দ্রিক। শিল্পকলায় আনাড়ি হলেও এসব কাজের তারিফ করতে জানি অবশ্য, আর সাগ্রহে দেখেও যেতে পারি ঘন্টার পর ঘন্টা। এছাড়া প্যারিসের প্রায় সব জাদুঘরেই আছে অডিওগাইডের ব্যবস্থা। জাদুঘর থেকে হেডফোন দিয়ে দেবে, ক্ষেত্রবিশেষে ডিভাইসও। এসবের মাধ্যমে ধারণকৃত অডিও থেকে জানা যাবে নির্দিষ্ট শিল্পবস্তু বা দর্শনীয় জিনিসের ইতিবৃত্ত। এছাড়া কিছু কিছু ক্ষেত্রে নিজের ফোনেই মোবাইল অ্যাপ ইনস্টল করে নেওয়া যায়, যা জাদুঘরের ভেতরে দিক খুঁজে পেতে কিংবা নির্দিষ্ট আকর্ষণীয় বস্তুটি খুঁজে পেতে যা কাজে দেয়।
সমর-ইতিহাস-শিল্প-সাহিত্য-বিজ্ঞান-দর্শন—এই সবকিছুতেই ফরাসিদের উৎকর্ষ আকাশ ছুঁয়েছে, এ-কথা বললে মোটেও অত্যুক্তি হবে না। আমার প্রধান আগ্রহের জায়গা অবশ্য সবসময়ই সাহিত্য। ভাঙ্গাভাঙ্গা যেটুকু ফরাসি শিখেছিলাম, তাতে ফরাসি সাহিত্য পড়তে চাওয়া বাতুলতা। কিন্তু অনুবাদ আমাকে ঋদ্ধ করেছে যথেষ্টই, অন্তত আমার তাই ধারণা। ফলে প্রিয় সাহিত্যিক বা শিল্পীদের স্মৃতিচিহ্ন ছুঁয়ে দেখবার তীব্র অভিলাষ যদি জাগতেই পারে। এমনিতে প্যারিস সবসময়ই সৃজনশীল ও মননশীল মানুষদের আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দু ছিলো। ফলে কেবল ফরাসিরা নন, সমস্ত পৃথিবী থেকে প্রখ্যাত মানুষরা এসে জীবনের অনেকটা সময় থেকেছেন প্যারিসে। প্যারিসে দীর্ঘদিন স্বেচ্ছানির্বাসনে থাকা চেক লেখক মিলান কুন্দেরা যখন প্রয়াত হন, তখন আমি প্যারিসেই। পিকাসো, ভ্যান গগ, অস্কার ওয়াইল্ড, জিম মরিসন, জেমস জয়েস, হেমিংওয়ে, দালি প্রমুখদের জীবনের উল্লেখযোগ্য অংশ কেটেছে প্যারিসে, যেখানে এঁদের অনেকের অন্তিমশয়ানও রচিত হয়েছে। বাংলা ভাষার অন্যতম শক্তিমান সাহিত্যিক সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর সমাধিও প্যারিসে।
অন্য যেকোনো দর্শনীয় স্থান দেখার সঙ্গে জাদুঘর দেখার কিছুটা তফাৎ আছে। জাদুঘর দেখতে হয় সময় নিয়ে, রসিয়ে রসিয়ে। একে তুলনা করা যেতে পারে এভাবে—আপনি রাজকীয় কোনো ভোজে নিমন্ত্রণ পেয়েছেন। সেখানে দেশবিদেশের খ্যাতনামা পাচকদের দুর্দান্ত সব পদ থরে-বিথরে সাজানো আছে। এখন আপনি তাড়াহুড়ো করলে তুলনামূলক কম সুস্বাদু কয়েকটা পদ খেয়েই পেট ভরে আইঢাই হয়ে যাবে। আবার ধীরেসুস্থে এগোলেও আপনি সব পদ খেতে পারবেন না, কারণ সংখ্যাটা আপনার ধারণক্ষমতার সহস্রগুণ বেশি এবং আপনার জন্য এই ভোজসভা অনন্তকাল চলবে না। তাছাড়া হুড়োহুড়ি করে ভালো ভালো পদ বেছে খেলেই তো হবে না, জিভকেও সময় দিতে হবে যাতে সে খাবারগুলোর প্রকৃত স্বাদও উপলব্ধি করতে পারে।
প্যারিসের নির্ধারিত জায়গাগুলো দেখার আগে আমার কাছে গুরুত্বপূর্ণ ছিলো শহরটাকে ভালোভাবে বোঝা। প্যারিস শহরের গঠন কিছুটা বৃত্তাকার। উপবৃত্তাকারও বলা যেতে পারে। শহরকে ঘিরে রাখা একটা প্রধান সড়ক হচ্ছে এই উপবৃত্তের পরিধি। উপবৃত্তের ভেতরে ঢুকে আবার বেরিয়ে গেছে সেন নদী। প্যারিসের বেশিরভাগ বিখ্যাত স্থাপনা সেন নদীর আশপাশে অবস্থিত। এই উপবৃত্ত বা মূল প্যারিস শহরের বাইরেও অবশ্য শহরাঞ্চল ছড়িয়ে আছে অনেকখানি জায়গা জুড়ে, তবে সেগুলোকে শহরতলি বলা যেতে পারে। এই অংশগুলো ততোটা ঘিঞ্জি নয়। ছড়ানো বাড়িঘর, লোকজন কিছুটা কম, পর্যটকের আনাগোনাও সেদিকে তেমন নেই। সাধারণত হৈহট্টগোল এড়াতে প্যারিসের অভিজাতরা একটু বাইরের দিকেই থাকেন। আমার আস্তানাও ছিলো এরকমই এক এলাকায়—তবে তার কারণ অবশ্য আভিজাত্য নয়, ঘরভাড়া কম বলে।
প্যারিস শহর ২০টি আরোঁদিসমঁ বা প্রশাসনিক অঞ্চলে বিভক্ত। আমি শুরুর একমাস ছিলাম ১৮ নম্বর আরোঁদিসমঁতে, যার অবস্থান ম্যাপের একদম উত্তরদিকে। আর পরের একমাস থেকেছি মঁরুজ এলাকায়, ১৪ নম্বর আরোঁদিসমঁতে, ম্যাপের ঠিক দক্ষিণে।
আমার প্রাথমিক পরিকল্পনা ছিলো প্যারিসের গোটাকতক বিখ্যাত স্থাপনায় যাওয়া, স্বনির্বাচিত কিছু জাদুঘর দেখে ফেলা, আর কয়েকটা সিমেট্রি ভ্রমণ। আগেই বলেছি, প্যারিসের সিমেট্রিগুলোতে অনেক বিখ্যাত মানুষ চিরশায়িত আছেন। তবে গোরস্থানে ঘোরাঘুরির আরও কারণ আছে। ইন্টারনেটে আগেই দেখেছিলাম, প্যারিসের এই সমাধিগুলোও বেশ শৈল্পিক ও দৃষ্টিনন্দন। শুধু তা-ই নয়, উন্মুক্ত পার্ক বা স্থাপনাগুলো, এমনকি পথের ধারে বিনামূল্যে খাবার জল সংগ্রহ করার ফোয়ারাটিতেও যেসব কারুকাজ বা ভাস্কর্য আছে তা সুরুচিরই পরিচয় দেয়। সব বাড়িঘরের বহিরাবরণে একধরণের আভিজাত্যের ছাপ আছে, বিশেষত বাহারি ব্যালকনি, দরজা বা ব্যালকনিতে। এটি মূলত পরিকল্পিত Haussmann’s renovation-এর অংশ। উনিশ শতকে তৃতীয় নেপোলিয়নের সময়ে এই প্রকল্পের মাধ্যমে প্যারিসকে ঢেলে সাজানো হয় । এই সবকিছু মিলিয়ে ইউরোপের কসমোপলিটান শহরটি আমাকে মুগ্ধ করে রেখেছে পুরোটা সময়।
প্যারিস দেখতে কতো সময় লাগা উচিত? এই প্রশ্নের বোধহয় সঠিক জবাব হয় না। যেকোনো শহরকে সত্যিকার অর্থে উপভোগ করতে হলে সেখানে যথেষ্ট সময় থাকতে হয়, বলাই বাহুল্য। সেই হিসেবে প্যারিসের ক্ষেত্রে হয়তো এক বছরও যথেষ্ট নয়। ঝটিকা সফরে এসে প্যারিসকে ভালোভাবে বোঝা যায় না—কারণ প্যারিস মানে কেবল আইফেল টাওয়ার বা লুভ্র মিউজিয়াম নয়।
প্যারিস এখন নানাবিধ বিড়ম্বনায় জর্জরিত, যার ভেতরে অন্যতম হচ্ছে অভিবাসী। এই সমস্যা অবশ্য তাদেরই ঔপনিবেশিক পাপের কর্মফল। ফ্রান্সের বেশিরভাগ উপনিবেশ ছিলো আফ্রিকায়। এই সাবেক কলোনিগুলো থেকে প্রচুর অভিবাসী অবৈধভাবে ফ্রান্সে আসে ভাগ্যান্বেষণে। সবচেয়ে বেশি আসে আলজেরিয়া আর মরক্কো থেকে। রাজনৈতিক আশ্রয়প্রার্থীদেরও প্রধান গন্তব্যস্থল ফ্রান্স। বাংলাদেশ থেকেও অনেকেই বৈধ-অবৈধ বিভিন্ন উপায়ে ফ্রান্সে গিয়ে রাজনৈতিক আশ্রয় দাবি করে বসে, যার বেশিরভাগই অসত্য তথ্যের ভিত্তিতে। আইনগত বাধ্যবাধকতার কারণে ফ্রান্স সরকার এদের জোর করে বের করে দিতে পারে না, যদিও এসব নমনীয় আইনে যাতে পরিবর্তন আনা হয় সেজন্য রক্ষণশীল রাজনৈতিক দলগুলোর তীব্র চাপ রয়েছে। অভিবাসীরা কাজের সন্ধানে ঘুরেফিরে সেই প্যারিসে এসেই ভিড় জমায়। পথেঘাটে, মেট্রো স্টেশনে গৃহহীন মানুষের ছড়াছড়ি দেখে ভূপেন হাজারিকার বিখ্যাত কলিটাই মনে পড়ে যায়—আমি দেখেছি অনেক গগনচুম্বী অট্টালিকার সারি, তার ছায়াতেই দেখেছি অনেক গৃহহীন নরনারী। তারপরও প্যারিসের আকর্ষণ পৃথিবীজুড়ে একটুও কমছে বলে মনে হয় না। এখন গ্রীষ্মকাল, অর্থাৎ ভ্রমণের জন্য সবচেয়ে প্রশস্ত ঋতু। আর সপ্তাহান্তের বন্ধের দিনে, অর্থাৎ শনি-রবিবারে তো কথাই নেই—প্যারিস একেবারে লোকে লোকারণ্য যাকে বলে।
অন্নদাশঙ্কর প্যারিসভ্রমণ করেছিলেন প্রায় শতবর্ষ আগে। সুনীলের প্যারিস দেখারও পঞ্চাশ বছর পেরিয়ে গেছে। তাঁদের ধ্রুপদী বর্ণনার তুলনায় অনেককিছুই বদলেছে—সেটাই স্বাভাবিক—কিন্তু আজও অন্নদাশঙ্করের মতো করেই বলতে হয়—তবু চুল তার পাকলো না।
*মূল লেখকের বানানরীতি অক্ষুণ্ণ রাখা হয়েছে
ছবিঘর
Gallery
ছবির উপর ক্লিক করে বড়ো আকারে দেখুন | Click on the image for a larger view
