প্যারিস দ্বিতীয় কিস্তি: নিখরচায় ঘোরাযোগ

শিবরাম চক্রবর্তী নিখরচায় জলযোগ শিরোনামে একটা রম্যগল্প লিখেছিলেন। সেই গল্পে মামা-ভাগ্নের বেজায় খিদে পেয়েছিলো, কিন্তু কারোর পকেটে পয়সাকড়ি নেই। তখন মামা—মানে নকুড়মামা—একটা সাংঘাতিক বুদ্ধি এঁটেছিলেন যাতে বিনেপয়সায় খাওয়ার বন্দোবস্ত হয়ে যায়। বুদ্ধিটা অবশ্য নীতিসিদ্ধ ছিল না, তবে ভালোই কাজে দিচ্ছিল। কিন্তু একটা ছোট্ট ভুলের জন্য একসময় এই দুর্বুদ্ধি ধরা পড়ে যায় আর সেজন্যও বেশ খানিকটা মাশুলও গুণতে হয়।

পরের পয়সায় ওরকম ভোজের অভিসন্ধি অবশ্য আমার নেই। এমনকি উদরপূর্তি নিয়েও আমার খুব মাথাব্যথা নেই। তবে প্যারিসের মতো ব্যয়বহুল শহরে নিজের পয়সা কিছুটা বাঁচাতে পারলে মন্দ কী? আমি চেয়েছিলাম সময়টাকে যথাসম্ভব কাজে লাগাতে,  আর কম খরচে কিংবা বিনাপয়সায় যতোটা পারি ঘোরাঘুরি করতে—অর্থাৎ যাতে আমার ঘটে আরেকটু ঘোরাযোগ ঘটে। কথাটা একটু বদলে নিয়ে ঘোড়াযোগ হলেও বিশেষ ক্ষতি ছিল না। সে-সময় একটা ঘোড়া যদি পেতাম, তাহলে কি প্রতিমাসে পাবলিক ট্রান্সপোর্ট পাশ বাবদ খসানো নগদ চুরাশিটা ইউরো বাঁচানো যেতো না? খুব যেতো। তাছাড়া ১৯০০ সালের গোড়ার দিকেও নাকি প্যারিসে প্রায় আশি হাজারের মতো ঘোড়া ছিলো, আর সে-সময় ঘোড়াই ছিলো সবচেয়ে জনপ্রিয় যান। কিন্তু ওসব হলো পুরনো কেচ্ছা। স্বভাবতই আজকের দিনে পথেঘাটে ওভাবে ঘোড়া দাবড়ানোর অনুমতি নেই। তাছাড়া থাকলেই বা কী—ঘোড়া পালার বায়নাক্কা নেহাত কম নয়, ঘোড়া চালাতেও জানি না, আর কোথায় পাওয়া যায় তা-ই কি ছাই জানি?

যাক বাজে কথা। সে-যাত্রায় প্যারিসে ঘোড়াযোগ না হলেও ঘোরাযোগ আমার হয়েছিলো বিস্তর। খরচ বাঁচানোর এক মোক্ষম উপায় দেখিয়েছিলো এডুকেশন সেক্টরে আমাদের টিমের একজন কোরীয় সদস্য, সি-হু। তার প্যারিসবাস ততদিনে বছরখানিকেরও বেশি হয়ে গেছে, অর্থাৎ তাকে এলাকার বড়োভাই বললে বিশেষ ক্ষতি নেই। আমাদের মতো টাকাপয়সা চেপেচুপে খরচ করার বালাই অবশ্য তার নেই, কারণ সে ইন্টার্ন নয়—রীতিমত কোরীয় সরকারের শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের চাকুরে। সরকারের উচ্চপর্যায়ের প্রতিনিধি হিসেবে ইউনেস্কোতে স্পেশালিস্ট‌ হিসেবে কাজ করছিলো সে-সময়। ওর সঙ্গে আমার খাতির জমে গেলো অন্য কারণে। আমি আসার আগ পর্যন্ত আমাদের রুমে পুরুষ সদস্য বলতে সে ছিলো একা। কয়েকজন পুরুষ কনসালটেন্ট ছিলেন অবশ্য, তবে তাঁরা হেডকোয়ার্টারে বসতেন না। এজন্য সি-হু বোধহয় কিছুটা কোণঠাসা হয়েই ছিলো। ফলে ক্রমশ আক্ষরিক অর্থেই খানিকটা ব্রোমান্স জন্ম নিলো আমাদের মধ্যে। বড়োভাই হিসেবে সে কিছু ঘাঁতঘোতেরও সন্ধানে দিলো। জানা গেল, প্রতি মাসের প্রথম রোববার প্যারিসের অনেকগুলো দর্শনীয় জায়গায় বিনেপয়সায় ঢুকতে দেয়। শুনে আমার চক্ষু ছানাবড়া। এই তথ্য আগেভাগে না জানায় আসার পরপর জুলাইয়ের যে-প্রথম রোববারটা পেয়েছিলাম সেটা ফস্কে‌ গেছে—এ-কথা ভেবে ভীষণ আফসোস হতে লাগলো। সামনে অবশ্য আরেকটা রোববার আসছে, আগস্টে। সেটাকে কাজে লাগানো যেতে পারে।

প্রবেশমূল্য ফ্রি বলে যে পুরোটা একেবারে বিনা মেহনতে—এমন নয়। ওইদিনের স্লট অনলাইনে বুক করতে হয়, নয়তো ঢুকতে দেবে না। দুর্ভাগ্যজনকভাবে এসব স্লট অনেক আগে থেকেই বুক্‌ড হয়ে থাকে। যেমন আমার তালিকায় সামনের দিকে থাকা লুভ্‌র, পিকাসো বা রোদাঁ মিউজিয়ামের স্লট বুক করা গেল না। ওয়েবসাইটে লাল অক্ষরে স্পষ্টভাবে লেখা—আসন খালি নাই। পরে জেনেছিলাম—এসব স্লটের জন্য রীতিমতো তক্কে তক্কে থাকতে হয়, বিশেষ করে সামারে, কারণ এই সময়টায় প্যারিসে পর্যটকের ঢল নামে। অগত্যা তালিকায় কিছুটা পেছনের দিকে থাকা মিউজিয়ামগুলোতে স্লট খোঁজা শুরু করলাম। শেষমেষ চারটিতে স্থির হলো।

আজি এ প্রভাতে রবির ধাম, কেমনে পশিল মিউজিয়াম

অবশেষে প্রতীক্ষিত সেই রোববার এলো। আমি তখন থাকতাম মঁরুজ এলাকায়। বাসা থেকে বের হলাম একদম সকাল-সকাল। প্রথম গন্তব্যস্থল ওজেন দ্যলাক্রোয়া মিউজিয়াম। মেট্রোতে করে সাঁ-জামাঁ-দি-প্রে স্টেশনে নেমে কিছুক্ষণ হাঁটতে হলো। মিউজিয়ামের সদর দরজায় পৌঁছে দেখি তখনো সেটা খোলেনি। বলে রাখা ভালো যে দ্যলাক্রোয়ার সবচেয়ে বিখ্যাত কাজ La Liberté guidant le peuple তখনো স্বচক্ষে দেখিনি। সেটার অবস্থান এই মিউজিয়ামে নয়, লুভ্‌রে। মিউজিয়ামটি মূলত ওজেন দ্যলাক্রোয়ার (১৭৯৮-১৮৬৩) সর্বশেষ অ্যাপার্টমেন্ট ছিলো। ফরাসিরা আধুনিকতার নামে বাড়িঘরের বেখাপ্পা সংস্কার করে না, আর প্যারিসে সেরকম করার অনুমতিও নেই। ফলে বাড়িটায় এখনো আঠারো শতকের ছাপ।

কিছুক্ষণ অপেক্ষার পর ঢোকার সময় হলো। ভেতরে গিয়ে মন ভালো হয়ে গেলো। ছোটো হলেও চমৎকার সাজানো-গোছানো মিউজিয়াম। ইংরেজি-বলিয়ে গাইড নিতে পারলে অবশ্য আরো ভালো হতো, তবে তাতে কিছুটা অতিরিক্ত খরচা পড়ে যায়। যাইহোক, নিজে নিজেই সময় নিয়ে সবগুলো কাজ দেখলাম। দোতলা ভবন। সবমিলিয়ে তিনটা কক্ষকে গ্যালারি বানানো হয়েছে, অর্থাৎ খুব বেশি বড়ো নয়। তাছাড়া এখানে তাঁর সব কাজও নেই, ছড়িয়েছিটিয়ে আছে সারা বিশ্বজুড়ে। এক লুভ্‌রেই আছে পঞ্চাশটিরও বেশি চিত্রকর্ম। অল্পকিছু আছে প্যারিসেরই আরেক বিখ্যাত জাদুঘর দর্সে-তে। দর্সে অবশ্য বেশি পরিচিত ভ্যান গগের Starry Night Over the Rhône এবং এদুয়ার মানের The Luncheon on the Grass-এর জন্য

দ্যলাক্রোয়া জাদুঘরের প্রদর্শনীতে শিল্পকর্মের পাশাপাশি শিল্পীর নিজস্ব সংগ্রহশালা এবং আঁকার কাজে ব্যবহার্য জিনিসপত্রও রাখা ছিলো। আমার সবচেয়ে পছন্দ হলো দ্যলাক্রোয়ার স্টুডিওটা। মূল অ্যাপার্টমেন্ট থেকে কয়েকফিট দূরত্বে অবস্থিত একটা আলাদা ভবনে। মূল বাসভবনের সঙ্গে সেটাকে সিঁড়িযুক্ত প্যাসেজ দিয়ে যুক্ত করা, সহজে যাতায়াত করা যায়। এই ধারণাটাকে আমি সমর্থন করি বলে বিশেষ ভালো লাগলো। সৃজনশীল কাজের সঙ্গে বাস্তব পৃথিবীরই বিস্তর সম্পর্ক আছে, তবে একজন সৃজনশীল মানুষকে স্রেফ বাস্তবতাই সর্বক্ষণ পীড়িত করবে—সেটাও ভীষণ অন্যায়। যেকোনো সৃষ্টির কাজ একধরনের ধ্যানমগ্নতার দাবি রাখে; নৈমিত্তিক সাংসারিক পরিবেশে সেটা সম্ভব হয় না। খানিকটা বিচ্ছিন্নতার প্রয়োজন পড়ে।

দ্যলাক্রোয়ার কাজে রোমান্টিসিজমের প্রভাব বেশি, ফলে অনুভূতির প্রকাশও অনেক বেশি শক্তিশালী। ব্যবহৃত রঙ আর স্ট্রোকে এই তীব্রতা চোখে পড়ে। ইম্প্রেশনিজমের মতো রোমান্টিসিজমও প্রথাগত অ্যাকাডেমিক আর্টকে চ্যালেঞ্জ করে। শিল্পকে স্রেফ সৌন্দর্যময় অবজেক্ট করে না তুলে সাবজেক্টিভিটিকে প্রাধান্য দেয়। বলাই বাহুল্য ফরাসি শিল্প-সমালোচকরা তখনো এসবের জন্য পুরোপুরি তৈরি নন, ফলে ওই সময়ে তাঁর কাজের এই শৈলী রীতিমতো বৈপ্লবিক।

দ্যলাক্রোয়ার বসতবাড়ি দেখা শেষ হলো। যাত্রা করলাম দ্বিতীয় গন্তব্যের দিকে, টাকার জাদুঘরে। সেন নদীর পাড়ে অবস্থিত। টাকাকড়ি তো নয়, রীতিমতো ইতিহাসের পাঠশালা। টাকার উৎপত্তি, ইতিহাস থেকে শুরু করে বিভিন্ন যুগের রঙবেরঙের টাকাকড়ি দেখতে অবশ্য মন্দ লাগলো না। তবে এত অল্পসময়ের ভেতরে সবকিছু দেখে কিংবা বুঝে ওঠা বেশ কঠিন। তবে শেষদিকে মজা হলো—যখন দেখলাম দর্শনার্থীরা কয়েন তৈরির একটা হস্তচালিত যন্ত্রে পয়সা বানাচ্ছে। তখন মনে পড়লো, আরে, ঢোকার সময় তো আমাকেও একটা পয়সা দিয়েছিলো। সেটা অবশ্য একেবারে নিরেট, গায়ে কিছু খোদাই করা ছিলো না। কেন? তখন বুঝিনি। সেই প্রশ্নের উত্তর এখন পাওয়া গেল। পয়সাটকে এই যন্ত্রের ছাঁচে ফেলতে হবে, তারপর যন্ত্রে চাপ দিয়ে নকশা বসাতে হবে নিজেকেই। বাহ, বেশ ভালো তো! তবে লোকের ভিড় লেগে আছে যন্ত্রটার আশপাশে। খানিকক্ষণ অপেক্ষার পর সুযোগ মিললো। তারপর আর কী, নিজেই নিজের পয়সা তৈরি করে ফেললাম! কাজটা নিয়মিত করতে পারলে ভালো হতো। তবে ওদের জাদুঘরের এই দিকটা খুব মজার। কিছু কিছু ইন্টারঅ্যাকটিভ অংশ রাখার চেষ্টা করে। তাতে কী হয়—বড়োরা যেমন আনন্দ পায়, তেমনি শিশুরাও পায়। যেমন ওই জাদুঘরেরই আরেকটা জায়গায় একটা যন্ত্রের পাশে রাখা ছিলো কিছু প্রমাণ আকৃতির প্রতীকী পয়সা, হাতের তালুর মতো বড়ো সেগুলো। ওগুলো একে একে তুলে যন্ত্রটার নির্দিষ্ট খোপে ফেলে দিলে টাচস্ক্রিনে সেই পয়সার উৎপত্তি, সময়কাল, উপাদান ইত্যাদির ইতিহাস দেখা যায়। বাচ্চারা দেখলাম মজা নিয়ে দেখছে, শিখছে। শিখনকে সহজলভ্য ও সহজবোধ্য করে তোলার কী চমৎকার চিন্তাভাবনা!

একদিনে অনেক বেশি টাকাপয়সা দেখে ফেলে খানিকটা অনুশোচনা হচ্ছিলো। ফলে প্রায়শ্চিত্তের অভিপ্রায়ে রওনা দিলাম বার্সি‌ পার্কের দিকে। গন্তব্যস্থল পার্কের পাশে অবস্থিত মেলিয়েস জাদুঘর—হ্যাঁ, প্রখ্যাত ফরাসি চলচ্চিত্রনির্মাতা ও অভিনেতা জর্জ মেলিয়েসের নামেই এটি—এবং হ্যাঁ, এটি চলচ্চিত্র-সংক্রান্ত জাদুঘর। চলচ্চিত্রের উৎপত্তি, ইতিহাস আর বিকাশ নিয়ে জানার জন্য চমৎকার একটা জায়গা, এমনটা জেনেই গিয়েছিলাম। কিন্তু গিয়ে একটা বড়সড় ধোঁকা খেলাম। কারণটা বলি। এই জাদুঘরে স্লট বুক করতে হয় না, এমনটাই দেখেছিলাম ওদের ওয়েবসাইটে। কিন্তু সেখানে অন্য একটা দরকারি কথা আমার চোখ এড়িয়ে গিয়েছিলো। প্রতিবছরের আগস্ট মাসে নাকি এই জাদুঘর পুরোপুরি বন্ধ থাকে। হা হতোস্মি! এজন্যই তো বলি—পুরো ভবনটাকে এতবার প্রদক্ষিণ করেও একটা খোলা দরজা খুঁজে পাচ্ছি না কেন! ওরে বোকচন্দ্র, খোলা থাকলে তবে না খোলা পাবি তুই!

খানিকটা আশাহত হয়ে অগত্যা যাত্রা করলাম চতুর্থ জাদুঘরের দিকে—লা সেন্টার পোঁপিদু। এই জাদুঘর মূলত মডার্ন আর্টের। কেন্দ্রটির নামকরণ হয়েছে সাবেক ফরাসি রাষ্ট্রপতি জর্জ পোঁপিদুর নামে। এতে জাদুঘর, গ্রন্থাগার, সঙ্গীত গবেষণাগার ইত্যাদি রয়েছে। জাদুঘরে ঢোকার জন্য এই একবারই এলেও গ্রন্থাগারটায় আমি আগে-পরে বেশ কয়েকবার গিয়েছি এবং সময় কাটিয়েছি। পোঁপিদু সেন্টারের একটা বিশেষত্ব হলো এর স্থাপত্যশৈলী, যা inside-out বা ভিতরবার উল্টো করা। অর্থাৎ একটা বহুতল ভবনে যেসব জিনিস ভেতরে থাকার কথা, সেগুলো এই ভবনে বাইরের দিকে—যেমন বায়ুনিষ্কাশনের নল, পানির পাইপ, চলন্ত সিঁড়ি ইত্যাদি। মজার বিষয় হলো এগুলো আবার রঙ অনুযায়ী আলাদা করা। বায়ু চলাচলের টিউবগুলো নীলরঙা, বিদ্যুতেরগুলো হলুদ, পানিরগুলো সবুজ আর এসকেলেটরেরগুলো লাল। এই বিশেষ বৈশিষ্ট্য ভবনটিকে আরো স্বতন্ত্র করে তুলেছে।

সেন্টার পোঁপিদু-তে প্রদর্শিত শিল্পকর্মগুলোর সৃষ্টিকাল ১৯০৫ সাল থেকে বর্তমান সময়কাল পর্যন্ত। অর্থাৎ কেবল সমসাময়িক নয়, যুগসন্ধিক্ষণের বিভিন্ন কাজও এতে রয়েছে। রয়েছে পাবলো পিকাসো, অঁরি মাতিস, যোয়ান মিরোর মতো শিল্পীদের কাজ। আমার খুব আফসোস হয়েছিলো যখন জেনেছি যে আমার প্রিয় শিল্পী ফ্রিদা কাহলোর একটা এক্সিবিশন কিছুদিন আগে এখানে হয়ে গেছে।

মডার্ন আর্ট নিয়ে আমার জানাশোনা কম। তবে পোঁপিদুতে এর পরিধির ব্যাপকতা দেখে বিস্মিত হই। অনুভব করতে পারি যে শিল্পের আক্ষরিক অর্থেই কোনো সীমারেখা নেই। কেবল বিমূর্ত চিত্রকর্মেই নয়, নানা আকৃতির ভাস্কর্যেও এই দ্রোহের দেখা মেলে—যেগুলোতে প্রস্ফুটিত হয়ে ওঠে প্রথাগত সংজ্ঞা কিংবা ধারণাকে ভেঙ্গেচুরে ফেলার সুতীব্র ইচ্ছে। তারপরও অবশ্য আধুনিক শিল্পকলাকে অনেক মানুষ উঁচুদরের কাজ বলে বিবেচনা করেন না। তাঁদেরকে গণহারে বেরসিক বলাটাও আবার ঝুঁকিপূর্ণ, কারণ এই তালিকায় বড়ো বড়ো নাম আছে। সহজ উদাহরণ হিসেবে এই মুহূর্তে সত্যজিৎ রায়ের কথা মনে পড়ছে। তাঁর শিল্পী শিরোনামের ছোটোগল্পটা পড়লে বোঝা যায় যে—তিনি বিমূর্ত শিল্পকে শিল্পের কাতারেই ধরছেন না। এসব ক্ষেত্রে সমালোচকদের অত্যন্ত কর্কশ কিন্তু খুবই জনপ্রিয় একটি তত্ত্ব হচ্ছে—কনটেম্পোরারি আর্ট প্রথাগত শিল্পে বিশেষ পারঙ্গম নয় এমন অলস ও অদক্ষ লোকেদের শিল্পী সাজার চেষ্টা।  কাকের পুচ্ছে ময়ূর পালক যাকে বলে। তবে আমার ব্যক্তিগতভাবে মনে হয়, অনর্থক বিরোধের সূত্রপাতও ঠিক এই জায়গাটা থেকেই হয়। শিল্প জিনিসটা নিজস্বধর্ম অনুযায়ীই বড়ো বেপরোয়া ও গতিশীল। একে কিছু নির্দিষ্ট ছাঁচে বন্দি করে রাখার চেষ্টাটাই বরং সমস্যাজনক। আধুনিক শিল্পকর্মকে বরং আমি আধুনিক মানবজীবনের জটিলতার প্রতিচ্ছবি হিসেবেই দেখি। কিছু কিছু কাজ দেখলে যেমন প্রবল শূন্যতার অনুভূতি তৈরি হয়, তেমনি কিছু কাজ অস্বস্তিতে ফেলে। আর আঙ্গিকের বৈচিত্র্যের কথা তো আগেই বলছি। পোঁপিদুতে এমনও দেখেছি যে—আস্ত ঘরটাই একটা শিল্পকর্ম (যেমন Plight by Joseph Beuys)। আবার অপটিক্যাল ইল্যুশনই কিছু আর্টের প্রধান বৈশিষ্ট্য (যেমন Salon Agam by Yaacov Agam)।

পোঁপিদু থেকে চমৎকার অনুভূতি এবং পায়ে বেশ তীব্র ব্যথা নিয়ে বাসায় ফিরলাম। জাদুঘরে ঘোরাঘুরি উপভোগ্য হলেও সহজ কাজ নয়। কারণটাও অনুমেয়, প্রচুর হাঁটতে হয়। সেখানে একদিনে তিনটা! অবশ্য চারটাও হতে পারতো। যাইহোক, এত ধকল শেষেও দিনটা ভালো গেছে আমার। ঘোরাযোগ ভালো হয়েছে।

বইয়ের যে-পাতায় আমরা বেঁচে থাকি

লোকে বলে—প্যারিসের নাকি সবই দেখার মতো। কথাটা অত্যুক্তি নয়। এমনকি প্যারিসের সমাধিস্থলগুলোও একপ্রকার দর্শনীয় জায়গা। শিল্পের শহর প্যারিস, কাজেই সেখানে শিল্পীদের সমাধি থাকবে সেটাই স্বাভাবিক। খোঁজখবর করে জানা গেল—সিমেট্রিগুলোর ভেতরে সবচেয়ে বিখ্যাতটির নাম পের লাশেজ (Père-Lachaise)। অন্য আরেকটি সিমেট্রি—সেটিও বেশ প্রসিদ্ধ—নাম মঁপারনাস (Montparnasse)। এছাড়া রয়েছে পাঁতিও (Panthéon), যার বাংলা অর্থ সর্বদেবতার মন্দির। বিখ্যাত কিছু মানুষের অন্তিমশয্যা রয়েছে সেখানে। পের লাশেজ এবং মঁপারনাস সমাধিক্ষেত্র সর্বসাধারণের জন্য উন্মুক্ত, তবে পাঁতিও ভ্রমণে প্রবেশমূল্য লাগে।

প্রথমে পরিকল্পনা করলাম মঁপারনাস ঘুরে আসার।

১৮২৪ সালে চালু হওয়া মঁপারনাস সিমেট্রির আকার প্রায় ৪৭ একর। অবস্থান রাসপাইল মেট্রো স্টেশনের একদম পাশে। এই স্টেশনটা আমাকে প্রায়শই ব্যবহার করতে হয়েছে, কারণ এখানে লাইন বদলে আমি ইউনেস্কো অভিমুখের মেট্রো ধরতাম। বেশিরভাগ মেট্রো স্টেশনই ভূগর্ভস্থ। ফলে যাতায়াতের সময়ে বাইরের পৃথিবীকে বিশেষ অনুভব করা যায় না। তবে  বেশিরভাগ প্যারিসিয়ান মেট্রো স্টেশনে প্রাসঙ্গিক স্থাপত্যশৈলী আর কারুকার্য রয়েছে। যেমন লুভ্‌রের সবচেয়ে কাছাকাছি মেট্রো স্টেশনের নাম লুভ্‌র-রিভলি, আর এখানে লুভ্‌র জাদুঘরে প্রদর্শিত কিছু বিখ্যাত সামগ্রীর রেপ্লিকা রাখা আছে। আবার আর্ট অ্যান্ড ক্র্যাফট জাদুঘরের পাশের স্টেশনটি সাবমেরিনের আদলে নকশা করা, যার অনুপ্রেরণা জুল ভার্নের টোয়েন্টি থাউজ্যান্ড লিগস আন্ডার দ্য সি। এজন্য স্টেশনগুলো দেখতে একঘেয়ে—এমনটা বলা ঠিক হবে না।

মঁপারনাসে গিয়েছিলাম জুলাইয়ের ২৯ তারিখে, শনিবারে। আকাশজুড়ে সেদিন ঘোলাটে মেঘ। সিমেট্রিতে ঢুকে ফোনে অফলাইন ম্যাপ বের করি। ইন্টারনেট ঘাঁটাঘাঁটি করে আগেভাগেই নোট্‌সে লিখে রেখেছিলাম বিভিন্ন বিখ্যাত কবরের অবস্থান (ব্লক, নম্বর)। পুরো সমাধিক্ষেত্রটিই বেশ গোছানো, ফলে নির্দিষ্ট সমাধি খুঁজে পেতে কোনো অসুবিধা হয় না। সুশৃঙ্খল হলেও বোঝা যায় যে, সময়ের সঙ্গে খানিকটা ঘিঞ্জি হয়েছে। মঁপারনাসে বর্তমানে সমাধিক্ষেত্রের সংখ্যা ৩৫,০০০, যদিও এতে শায়িত মানুষের সংখ্যা আনুমানিক তিন লক্ষেরও বেশি। কবরের পুনর্ব্যবহার তো করতেই হয়—কিন্তু তাতেও কুলিয়ে ওঠা যায় না, কারণ প্রতিবছর প্রায় হাজারখানিক মানুষের নাম তালিকায় যুক্ত হচ্ছে প্যারিসের দ্বিতীয় বৃহত্তম এই সিমেট্রিতে।

এটা ছিলো কোনো পশ্চিমা সমাধিক্ষেত্রে আমার প্রথম প্রবেশ। কবরস্থান কি মুগ্ধতার জায়গা? আমার জানা নেই। তবে আমার মন ভালো হয়ে গেল নিমেষে। শুরুতেই চোখে পড়ে প্রচুর গাছপালা, যাদের উঁচু শরীর আর ছড়ানো ডালপালায় চারিদিকে ছায়া-ছায়া স্যাঁতস্যাঁতে একটা ভাব আছে। অল্প-অল্প হাওয়া দিচ্ছে। শান্ত-নিরিবিলি পরিবেশ। প্রচণ্ড ব্যস্ত শহরটার ভেতরেও যেন একচিলতে স্থবির পৃথিবী—যেখানে সকল প্রতিযোগিতার প্রয়োজন ফুরিয়েছে। পরে জেনেছি মঁপারনাসে চল্লিশ প্রজাতির প্রায় ১২০০ গাছ আছে। এছাড়া সমাধিগুলোর শৈল্পিক বৈশিষ্ট্যের কথা তো বলতেই হবে। এত চমৎকার সব কারুকার্য আর ভাস্কর্য একেকটার ওপরে, আশপাশে, যেন সমাধিক্ষেত্র নয়, রীতিমত শিল্প-প্রদর্শনী! বেশিরভাগ নকশাই মুগ্ধতা ছড়ায়, তবে এমনও কিছু কিছু আছে যেগুলো মনে খানিকটা ভীতিকর রোমাঞ্চের সঞ্চার করে। সেটাও একপ্রকার অভিজ্ঞতা বৈকি!

শুরুতেই দেখা মিললো জঁ-পল সার্ত্র এবং সিমন দ্য বোভোয়ারের। অভিন্ন কবরে শায়িত দুজনে। সার্ত্র মারা গিয়েছিলেন বোভোয়ারের ছ’বছর আগে। তার আগ পর্যন্ত প্রায় পঞ্চাশ বছর ধরে প্রথাগত নিয়মের সম্পূর্ণ বাইরে এক রোমান্টিক যুগল ছিলেন তাঁরা। ভালোবাসার সবচেয়ে বড়ো শত্রু সম্ভবত অহং ও ঈর্ষা, সম্পর্কের ধরনের কারণে যা তাঁরা অনেকটাই অগ্রাহ্য করতে পেরেছেন বলে অনুমান করা হয়। দেখলাম, কবরের ওপরে কিছু তাজা ফুল রাখা। তবে সবচেয়ে চোখে পড়ে সমাধিফলকজুড়ে ছড়িয়ে থাকা অজস্র লিপস্টিকের দাগ। দেখে খানিকটা কৌতূহল হলো। মেয়েরা নাহয় তাদের কাছে তুলনামূলক সহজ এই প্রক্রিয়ায় ভালোবাসা দেগে রাখে, প্রগাঢ় অনুভুতি প্রকাশ করে। ছেলেদের অমন ভাবাবেশ এলে তারা কী করে? বলা মুশকিল।

আরেকটু এগোতেই পাওয়া গেল এমিল ডুর্খেইমের সমাধি। সুইসাইড বইয়ের কল্যাণে যাঁকে আমি বিশেষ শ্রদ্ধার চোখে দেখি। আত্মহত্যার এত যুগান্তকারী সমাজতাত্ত্বিক ও গবেষণাভিত্তিক বিশ্লেষণ তাঁর আগে কেউই করতে পারেনি। আত্মহত্যাকে আজও স্রেফ মানসিক বিকার ও দুর্বলতা হিসেবে সাব্যাস্ত করার একধরনের প্রচেষ্টা দেখি প্রায়ই। দেখে মনে হয় যেন বিষয়টি পুরোপুরি জৈবিক এবং ব্যক্তিগত কর্মকাণ্ড। অথচ ডুর্খেইম রীতিমত তথ্যউপাত্ত বিশ্লেষণ করে এবং পরিসংখ্যান দিয়ে দেখিয়েছেন যে—মানুষের জেন্ডার, বৈবাহিক অবস্থা, ধর্মীয় পরিচয়, শিক্ষা ইত্যাদি কীভাবে আত্মহত্যার ফ্যাক্টর হিসেবে কাজ করে। আত্মহত্যার যে শ্রেণিবিন্যাস তিনি করে গেছেন তা আজও প্রাসঙ্গিক বিবেচনা করা হয়। দেখা গেল ডুর্খেইমের কবরের ওপরেও কিছু টাটকা ফুল রাখা। সেখানে আবার নুড়িপাথর দিয়ে কে-যেন হৃদয়ের একটা আকৃতি বানিয়ে রেখে গেছে। অ্যাকাডেমিশিয়ানদেরও এসব ভালোবাসা-টাসা মন্দ জোটে না তাহলে।

কিছুক্ষণ পর পৌঁছে গেলাম শার্ল বোদলেয়ারের কবরের সামনে। এটি অবশ্য কবির নিজস্ব কবর নয়, তাঁর সৎবাবার পারিবারিক কবর। সুনীল তাঁর ছবির দেশে, কবিতার দেশে-তে বোদলেয়ারকে নিয়ে যে-চমৎকার বিবরণ দিয়েছেন, সেটিকে ছাপিয়ে যাওয়ার মতো রসদ আমার নেই। সেই চেষ্টাও করছি না। তবে বোদলেয়ারের নামের ওপরে এবং আশপাশে আবারও নারীভক্তদের ঠোঁটের আক্রমণ দেখা গেল। আহা, কবি! আর্থিক অনটন আর সম্পর্কের জটিলতার চাপে অতিষ্ঠ এক মানবজীবন যে একটা সময় এরকম দুর্নিবার ভালোবাসায় ভেসে যাবে, এমনটাই তো হবার ছিলো।

বোদলেয়ারের মূল কবরটি একক নয়, এজন্য তাঁর স্মরণার্থে এই সমাধিক্ষেত্রেই একটি কবরবিহীন ভাস্কর্য করা হয়েছে—ইংরেজিতে যাকে বলে সেনোটাফ (Cenotaph)। কিছুক্ষণ হাঁটার পর সেটারও দেখা পাওয়া গেল। একটা সাধারণ সমাধির আকৃতিতেই তৈরি, যার ওপরে চিৎ হয়ে শুয়ে আছে একটি কংক্রিটের দেহ। মাথার দিকের প্রান্তে সোজা উঠে গেছে একটা সরু স্তম্ভ, আর তার চূড়ায় চিবুকে দুহাত দিয়ে সামনের দিকে চেয়ে আছেন বোদলেয়ার। ভাস্করের তারিফ করতেই হয়। বোদলেয়ারের চোখের জায়গাটায় আদতে কিছু নেই, তবু স্পষ্টতই মনে হয় যেন তীক্ষ্ণচোখ আর ধারালো চেহারায় একদৃষ্টে তাকিয়ে আছেন কবি।

সবশেষে গি দ্য মোপাসঁর সমাধি। তাঁর সবচেয়ে বিখ্যাত গল্পটি অনেকেই পড়ে থাকবেন—কণ্ঠহার (ফরাসি La Parure, ইংরেজিতে The Necklace)। আমারও এটা দিয়েই শুরু। তবে শখের বশে নয়, বিশ্ববিদ্যালয়ে থাকতে পাঠ্যক্রমের অংশ হিসেবে পড়েছিলাম। বাংলাদেশের উচ্চমাধ্যমিক শ্রেণির বাংলা বইতেও গল্পটি সংযোজিত হয়েছে, যদিও আমাদের সময়ে ছিলো না। গল্পটা প্রথম প্রকাশিত হয় ১৮৮৪ সালে।

মোপাসঁকে প্রায়শই আধুনিক ছোটোগল্পের জনক বলা হয়। রিয়েলিজম ও ন্যাচারালিজম তাঁর লেখার অন্যতম বৈশিষ্ট্য। যুদ্ধক্ষেত্রকে খুব কাছ থেকে দেখেছিলেন ফ্রাঙ্কো-প্রুশিয়ান যুদ্ধের সময়ে, যেটি তাঁর পরবর্তী অনেক লেখাকে প্রভাবিত করেছে। যেকোনো সাহিত্যিকের ক্ষেত্রেই আমার আগ্রহের জায়গা থাকে তাঁর অভিজ্ঞতা ও অনুপ্রেরণার উৎস নিয়ে। ফিকশন—হোক চরম রিয়েলিজম কিংবা চরম ফ্যান্টাসিঘেঁষা—এর অনুপ্রেরণা বাস্তব পৃথিবী থেকেই আসতে হবে। মোটাদাগে যদি পার্থক্য করি—প্রতিটি মানুষের জীবনেই অজস্র বিচিত্র অভিজ্ঞতা হয়, সেগুলো মানুষকে ব্যক্তিগত পর্যায়ে ঋদ্ধও করে। কিন্তু একজন শিল্পীর অভিজ্ঞতা অজস্র মানুষকে সমৃদ্ধ করার ক্ষমতা রাখে। অনেকটা অ্যামপ্লিফিকেশনের মতো ব্যাপারটা। একটা ছোটো ঘটনা হয়তো আরো অনেকেই দেখবে, সেটা নিয়ে ভাববে, খানিকটা কল্পনাও করবে, কিন্তু এসব বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই থেকে যাবে স্রেফ নিজের ভেতরে। যিনি ভালো লেখক নন, তাঁর খসখসে বর্ণনা কিংবা অতিরিক্ত রঙ চড়ানোর ফলে অপরিশোধিত (raw) রূপটি বিকৃত হয়ে পড়বে কিংবা অবোধ্য হয়ে উঠবে, এমন আশঙ্কা সবসময়ই থেকে যায়। কিন্তু একজন সুলেখক যখন নিজের কল্পবিশ্বকে সুচারুভাবে গড়বেন, সূক্ষ্মভাবে সম্পূর্ণ করবেন, তারপর সুকৌশলে ছড়িয়ে দেবেন—সেটিকে অপরিশোধিত অনুভূতির অবিকৃত প্রকাশ বলেই মনে হবে। এটাই শৈল্পিক স্পর্শের (artistic touch) শক্তি।

মোপাসঁর সমাধিকে অন্য অনেক সমাধির চেয়ে সাদামাটাই বলা চলে। ওপরে কংক্রিটের ঢালাই বা ভাস্কর্য নেই, তার বদলে মাটি আর ফুলগাছ। একটা সমাধিফলক আছে অবশ্য, তাতে বড়ো বড়ো করে নাম লেখা। এই সমাধি পরিদর্শনের মধ্য দিয়েই মঁপারনাস ভ্রমণের ইতি টানলাম।

সমাধিক্ষেত্রে হাঁটতে গিয়ে অবশ্য আরো অজস্র কৌতূহলোদ্দীপক ও দৃষ্টিনন্দন সমাধির দেখা পেয়েছি। ফরাসি রাজনীতিবিদ, অভিজাত পরিবার থেকে শুরু করে স্বল্পখ্যাত ও অখ্যাত অনেকেরই জায়গা হয়েছে এখানে। এঁদের সকলেই যুগান্তকারী কাজ করে যাননি, ফলে শতক পেরিয়ে অনেক মানুষের কাছে স্মরণার্হ থাকার উপায় তাঁদের নেই।

কিন্তু তবু তো মানুষ স্মরণ করে। অন্তত যতোদিন বেঁচে থাকে সবচেয়ে কাছের লোকগুলো। সেরকমই একটি কবর চোখে পড়েছিলো। মাত্র বত্রিশ বছর বয়সে জীবনাবসান হওয়া মিষ্টি চেহারার ফরাসি নারীটির একটা রঙিন ছবি কবরের ওপরে খোদাই করা। তবে নামটা পরিচিত লাগলো না। ইন্টারনেট ঘেঁটেও কিছুই পাওয়া গেল না, অর্থাৎ খুব বিখ্যাত কেউ ছিলেন না। কিন্তু তেরো বছরের পুরোনো সমাধিটির ওপরে অজস্র তাজা ও শুকনো ফুল ছড়ানো। ফুলের ফাঁকফোকর দিয়ে উঁকি দিচ্ছে আলফোঁস দ্য লামার্তিনের একটা ছোট্ট কবিতাংশ। অনুবাদ করলে দাঁড়ায়―

সর্বশ্রেষ্ঠ বই হচ্ছে জীবনের বই—
যথেচ্ছভাবে যা বন্ধ করা যায় না, খোলাও যায় না;
এবং কখনো পছন্দের পাতাগুলোকে আবার পড়তে চাইলে
সেখানে ফিরে যাওয়া যায় না। কিন্তু নিয়তির পৃষ্ঠাগুলো অবশ্য
উল্টে চলে নিজ থেকেই। যদিও একজন মানুষ কেবলই ফিরে যেতে চায়
প্রেমপূর্ণ পাতাগুলোতে, কিন্তু তার আঙ্গুলের ঠিক নিচেই
চুপচাপ অপেক্ষা করতে থাকে
মহাপ্রয়াণের পৃষ্ঠাটি।

পৃথিবীর সেরা সমাধিক্ষেত্রে

সপ্তাহদুয়েক পর দেখতে গেলাম পের লাশেজ। শব্দটা আদতে ফরাসি, তবে আমি বাঙালি বলেই কি শ্লেষটা চোখে লাগছে? যেন অনেকগুলো লাশ আছে বলেই জায়গাটাকে লাশেজ ডাকতে হবে?—যাব্বাবা!

শিরোনামেই বলেছি যে পের লাশেজ কেবল প্যারিসের নয়, ফ্রান্সের নয়, এমনকি ইউরোপেরও নয়—পুরো পৃথিবীরই সবচেয়ে বিখ্যাত সিমেট্রি। প্রায় সোয়া দুশো বছর আগে প্রতিষ্ঠিত (১৮০৪) এই সমাধিক্ষেত্র আকারে মঁপারনাসের চেয়ে বেশ বড়ো—প্রায় তিনগুণ, আর সমাধির সংখ্যা সত্তর হাজারের কাছাকাছি। জায়গাটাকে প্যারিসের অন্যতম ভ্রমণ-গন্তব্য বিবেচনা করা হয়। প্রতিবছর গড়ে পঁয়ত্রিশ লক্ষের বেশি দর্শনার্থী ঘুরতে আসে, যা অন্য যেকোনো সিমেট্রির দর্শনার্থীর সংখ্যার চেয়ে বেশি। সবচেয়ে বিখ্যাত বলার এটা অন্যতম কারণ। আরেকটা কারণ, এতে সমাহিত বিখ্যাত মানুষদের তালিকা—যা আসলেই বেশ দীর্ঘ!

ভেতরে প্রবেশ করে বোঝা গেল, পের লাশেজ তার খ্যাতির কারণে নগর কর্তৃপক্ষের তরফ থেকে খানিকটা বেশি যত্নআত্তি পায়। অবশ্য রোজগেরে সন্তানরা যেখানে মা-বাবারই চোখের মণি হয়ে থাকে—সেখানে মিউনিসিপ্যালিটির নিরপেক্ষ থাকতে বয়েই গেছে। পের লাশেজের হাঁটার রাস্তাগুলো তুলনামূলক চওড়া, পরিবেশ মঁপারনাসের চেয়ে পরিচ্ছন্ন, আর কবরগুলোর অবস্থান কিছুটা ফাঁকা-ফাঁকা।

খুঁজে খুঁজে প্রথম যে-কবরটা দেখলাম—সেটা অস্কার ওয়াইল্ডের। ভিক্টোরিয়ান যুগের অন্যতম শ্রেষ্ঠ এই আইরিশ সাহিত্যিকের শেষশয্যা প্যারিসে হওয়ার পেছনে খানিকটা ইতিহাস আছে। মূল কারণ ছিল যৌনতা। যৌবনের শুরুতে অস্কার একজন নারীকে বিয়ে করেছিলেন, সন্তানের বাবাও হয়েছিলেন। কিন্তু একটা পর্যায়ে বুঝতে পারেন যে তিনি সমকামিতায় আকৃষ্ট হচ্ছেন। বৈবাহিক সম্পর্কে থাকা অবস্থাতেই সমলিঙ্গের সম্পর্কে জড়িয়ে যান। এই সময়কালে আবার সন্তানের বাবাও হন। সবমিলিয়ে বিষয়টা জটিল—এজন্য তাঁকে চট করে উভকামী বা সমকামী কোনোটা বলে ফেলা শক্ত। যাইহোক, অস্কার যখন আরেক সাহিত্যিক লর্ড আলফ্রেড ডগলাসের সঙ্গে প্রেমের সম্পর্কে জড়ান, তখন পরিস্থিতি কিছুটা প্রতিকূল হতে থাকে। আলফ্রেডের বাবা ছিলেন রাগী মানুষ। ব্যাপারটা তিনি মেনে নেননি। সেটা ১৮৯৫ সালের কথা। তৎকালীন গ্রেট ব্রিটেনে সমকামিতাকে সামাজিকভাবে ও আইনগতভাবে মারাত্মক অপরাধ বিবেচনা করা হতো। আলফ্রেডের বাবা অস্কারের বিরুদ্ধে আদালতে অভিযোগ দেন। ব্যক্তিগত অবস্থানের জের ধরে অস্কারের লেখালিখির শালীনতাবোধ নিয়েও বিভিন্ন প্রশ্ন ওঠে। কাছের মানুষজন তাঁকে পরামর্শ দেয় ফ্রান্সে পালিয়ে যেতে। কিন্তু অস্কার রাজি হননি। তাঁর বিশ্বাস ছিলো—এত সহজে সবকিছু শেষ হয়ে যেতে পারে না। কিন্তু তাঁকে গ্রেপ্তার করা হলো। বিচারকার্য চলাকালে তাঁকে বিশেষভাবে ডগলাসের লেখা Two Lovers কবিতাকে কেন্দ্র করে আক্রমণ করা হলো। প্রতিপক্ষ থেকে যুক্তি দেওয়া হলো, কবিতার The love that dare not speak its name বাক্যটিতে ‘মারাত্মক অশালীনতা’ প্রকাশ পেয়েছে। জুরিদের সামনে অস্কার অবশ্য দুর্দান্তভাবে ব্যাখ্যা করলেন যে, এতে আসলে সকাম নয়, বরং প্লেটোনিক বা কামবিহীন ভালোবাসার কথা বলা হয়েছে। জুরিরা দ্বিধায় ভুগলেন, কোনো সিদ্ধান্তে আসতে পারলেন না। কিন্তু পরবর্তীতে ফের বিচারের আয়োজন হলে সেখানে অস্কারকে দুই বছরের সশ্রম সাজা দেওয়া হয়, যা ছিলো তখনকার হিসেবে সর্বোচ্চ। এই সময়টায় ধারণাতীত কষ্ট করেছেন তিনি, তবে লেখালিখি অব্যহত রেখেছিলেন। সাজাভোগের মেয়াদ শেষ হয় ১৮৯৮ সালে। এবার আর দ্বিধান্বিত হননি; কপর্দকশূন্য অবস্থাতেই প্যারিসে চলে আসেন। উদ্দেশ্য ছিলো আবার পুরোদমে লেখালিখি করবেন, নতুন করে সবকিছু গড়বেন। পারেননি, কারণ এরপর বেঁচেছিলেন আর মাত্র দুবছর। আসলে সাজা খাটার সময়েই তাঁর শরীর ভেঙ্গে পড়েছিল, যা আর কখনো সেরে ওঠেনি। ৪৬ বছর বয়সে প্রয়াত হওয়া সাহিত্যিকের অবশেষে স্থায়ী জায়গা হয় পের লাশেজে।

এই গল্পের একটা সমাপ্তি আছে। দ্য ইমিটেশন গেইম চলচ্চিত্রের সুবাদের অ্যালান টুরিং-এর নাম অনেকেই জানেন। সমকামিতা-সংক্রান্ত অন্যায় বিচার ও শাস্তির মুখোমুখি হয়েছিলেন এই তুখোড় গণিতবিদও। মানসিক চাপ ও শারীরিক নিগৃহন সহ্য করতে না পেরে তিনি একপর্যায়ে আত্মহনন করেছিলেন। রাষ্ট্র অবশেষে এই ঐতিহাসিক অন্যায় স্বীকার করে নেয়, আর টুরিং-এর নামেই ২০১৭ সালে একটি আইন পাশ হয়, যাতে পূর্বতন আইনের ভিত্তিতে অপরাধী সাব্যাস্ত করা সকলকে বেকসুর ঘোষণা করা হয়। এই তালিকায় ছিলেন অস্কার ওয়াইল্ডও।

আরেকটা তথ্য দিই। পের লাশেজের সকল কবরের ভেতরে এককভাবে সবচেয়ে বেশি চুম্বন পড়ে অস্কার ওয়াইল্ডের কবরের ওপরে। আহা!

খানিকটা এগিয়ে ফরাসি রসায়নবিদ জোসেফ লুই গে-লুসাকের সমাধি পাওয়া গেল, গ্যাস-আয়তন সূত্রের জন্য যিনি বিখ্যাত। এর খানিকটা পাশেই স্যামুয়েল হ্যানিম্যানের কবর। লাইপ্‌ৎসিশ (Leipzig) বিশ্ববিদ্যালয়ে মেডিসিন নিয়ে পড়লেও হ্যানিম্যান পরবর্তীতে একটা সময় হোমিওপ্যাথি আবিষ্কার করেন এবং অ্যালোপ্যাথির ঘোর বিরোধিতা শুরু করেন। উত্তরসূরিদের ভেতরে এই বিরোধ আজও চলমান, যদিও একটা সময় ধরে হোমিওপ্যাথির বেশ বাড়বাড়ন্ত থাকলেও এখন সেই সুদিন আর নেই। একে আর নির্ভরযোগ্য চিকিৎসাপদ্ধতি বলে বিবেচনা করা হয় না। আমেরিকান মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশন, যুক্তরাজ্যের এনএইচএস, এমনকি বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থাও হোমিওপ্যাথির শরণাপন্ন হতে নিরুৎসাহিত করে।

এরপর ওগ্যুস্ত কোঁৎ-এর সমাধির দেখা মিললো। এর কিছুদিন আগে তাঁর মিউজিয়াম দেখার চেষ্টা করে বিফল হয়েছি। কোঁৎ তাঁর জীবনের শেষ সময়ের অনেকটাই শহরের কেন্দ্রের দিকের একটা অ্যাপার্টমেন্টে কাটিয়েছিলেন। সেখানে বসেই তিনি লিখেছেন তাঁর বিখ্যাত Système de politique positive বইয়ের চারটি খণ্ড। সেটাকে এখন জাদুঘর করা হয়েছে। তবে বিভিন্ন জায়গার রিভিউতে দেখেছি যে সেটা বেশিরভাগ সময়ই বন্ধ থাকে, আর সময়সূচি দেয়া থাকলেও তা বিশেষ মানে না। তবু আশায়-আশায় গিয়েছিলাম। হলো না, বন্ধ। ভেবেছিলাম পরে আরেকবার চেষ্টা করে দেখব, হয়ে ওঠেনি।

সমাজবিজ্ঞানের আলোচনায় ওগ্যুস্ত কোঁৎ একপ্রকার অপরিহার্য। তাঁকে বলা হয় জ্ঞানের এই যুগান্তকারী শাখার জনক। কোঁৎ তাঁর লেখায় উল্লেখ করেছিলেন ফরাসি sociologie শব্দটি, যেটি ইংরেজিতে হয়ে ওঠে Sociology। সমাজের প্রগতির রূপরেখা ব্যাখার জন্য তাঁর থিওরি অব পজিটিভিটি-কে গুরুত্বপূর্ণ অবদান হিসেবে মনে করা হয়। এমিল ডুর্খেইম, হার্বার্ট স্পেন্সার, জর্জ এলিয়টরা কোঁতের কাজ থেকে অনুপ্রেরণা পেয়েছেন।

খানিকটা ঘুরপথ হেঁটে পাওয়া গেল আরেকজন সমাজবিজ্ঞানীর সমাধি। তিনি অবশ্য অত পুরোনো নন, গত হয়েছেন ২০০২ সালে, তবে ইতোমধ্যেই অত্যন্ত প্রভাবশালী হিসেবে স্বীকৃত হয়েছেন। পিয়ার বোর্দিউ। যেহেতু আমি শিক্ষা-গবেষণার মানুষ, নামটা নিয়ে নাড়াচাড়া করতে হয়েছে একাধিকবার—বিশেষভাবে কালচারাল ক্যাপিটাল আর হ্যাবিটাস তত্ত্ব নিয়ে কাজ করার সুযোগ হয়েছে। এখনকার সময়ে সামাজিক কাঠামোতে বিদ্যমান বৈষম্য-সংক্রান্ত গবেষণায় বোর্দিউ প্রায় অপরিহার্য।

হাঁটতে হাঁটতে এ-পর্যায়ে খানিকটা প্রতিকূলতার মুখোমুখি হতে হলো। আগেই বলেছি জায়গাটা বড়ো। কিন্তু পুরোটা যে সমতল নয় সেই তথ্য আমার জানা ছিলো না। অনেকাংশই বেশ উঁচুনিচু টিলার মতো। বেশ কয়েকটি জায়গায় দীর্ঘ সিঁড়ি ভাঙতে হলো। আপাতত রণেভঙ্গ দিয়ে পরে আবার আসবো কিনা সেই ভাবনাও মাথায় এসেছে। পরে ভাবলাম, এই অল্প কয়েকটা দিনই আছে হাতে। আর কি হে হবে দেখা! ভাগ্যে পুরো সিমেট্রিতে বসার মতো জায়গার অভাব নেই আর খাবার জলের উৎসও অফুরান, বিনামূল্যে যতো ইচ্ছে বোতলে ভরে নেওয়া যায়। কাছে অল্পকিছু স্ন্যাকসও আছে। তাড়াহুড়ো না করে ধীরে ধীরে হাঁটার সিদ্ধান্ত নিলাম। একা ঘোরাঘুরিতে যেমন সুবিধা অনেক, আবার অসুবিধাও কম নয়। একেকসময় একেকটা প্রকট হয়ে ওঠে আরকি।

খানিকক্ষণ জিরোনোর পর প্রখ্যাত সুরকার ফ্রেদেরিক শোপাঁর কবরের দিকে অগ্রসর হলাম, পিয়ানোতে যিনি তুলেছিলেন হৃদয়-নিংড়ানো গভীর আবেগ-মথিত প্রাণবন্ত সুর, যে-কারণে আদর করে যাঁকে পিয়ানোর কবি (Poet of the Piano) বলে ডাকা হয়। যদিও প্যারিসের এই কবরে শুয়ে থাকা শোপাঁর কোনো হৃদয় নেই। কথাটা শুনতে হেঁয়ালি মনে হলেও সত্যভাষণ। ব্যাখ্যা করার আগে তাঁর জীবন নিয়ে বলি।

শোপাঁর বাবা জাতে ফরাসি ছিলেন, কাজের সূত্রে পোল্যান্ড-অভিবাসী হয়েছিলেন। সেখানেই শোপাঁর জন্ম আর বেড়ে ওঠা। তিনি ছিলেন অতিপ্রতিভাবান শিশু (Child Prodigy)। ওয়ারশতে সঙ্গীতে হাতেখড়ি হলেও নিজেকে সেখানে বন্দি রাখতে চাননি। মা-বাবার আর্থিক সঙ্গতি খুব বেশি ছিলো না, কিন্তু প্রতিভাবান সন্তানের স্বপ্ন ও সম্ভাবনার কদর করেছিলেন তাঁরা। তাঁদের সহায়তায় শোঁপা সঙ্গীত নিয়ে উচ্চতর পড়াশোনা করতে অস্ট্রিয়া যান। পরে জার্মানি আর ইতালি ঘুরে অবশেষে প্যারিসে। সেখানে সৃষ্টিশীলতার গুরুত্বপূর্ণ বেশকিছু বছর অতিবাহিত হয়। এরপর দুর্ভাগ্যবশত যক্ষায় আক্রান্ত হন, দীর্ঘদিন ভোগেন। শেষমেষ যক্ষাতেই মাত্র ৩৯ বছর বয়সে জীবনাবসান ঘটে।

মৃত্যুশয্যায় শোপাঁ বোনকে তাঁর শেষ ইচ্ছে জানান—মারা যাওয়ার পর দেহ থেকে হৃৎপিণ্ড ছিন্ন করে সেটিকে পোল্যান্ডে সমাহিত করতে হবে। এর পেছনে দুটি কারণ ছিলো। প্রথমটা অনুমেয়, স্বদেশে ফেরার করুণ আকুতি। দ্বিতীয়টি কিছুটা অদ্ভুত। উনিশ শতকে জনমানসে একটা বিশেষ ভয় খুব বেশি ছড়িয়ে গিয়েছিল। অনেকের মনে ধারণা জন্মেছিল যে, মৃত্যু ঠিকঠাক হয়েছে কিনা তা ভালোভাবে নিশ্চিত না হয়েই বাকিরা তাড়াহুড়ো করে তাকে কফিনবন্দি করে ফেলবে। এই ভীতিকে বলা হয় ট্যাফোফোবিয়া। শোপাঁর মনে এটা বেশ প্রকট ছিল। একবার হৃৎপিণ্ড বের করে ফেললে আর কিছু না-হোক জ্যান্ত অবস্থায় কবর হওয়ার ভয় তো নেই! যাইহোক, ভাইয়ের অন্তিম আকুতি বোন উপেক্ষা করতে পারেননি। জারে সংরক্ষণ করে হৃৎপিণ্ডটি তিনি নিজেই বহন করে নিয়ে যান। রাশিয়া-নিয়ন্ত্রিত পোল্যান্ডে তাঁকে এটা একপ্রকার চোরাচালান করে নিয়ে যেতে হয়।

আজও শোপাঁর হৃৎপিণ্ড ওয়ারশর হলি ক্রস চার্চের একটা স্তম্ভের ভেতরে সযত্নে রক্ষিত আছে। আর এখানে শায়িত আছেন হৃদয়বিহীন শোপাঁ।

রোববারের অভিযানে ওজেন দ্যলাক্রোয়া মিউজিয়ামে যাওয়ার কথা জানিয়েছিলাম। তাঁর কবরও পের লাশেজে, শোপাঁর কাছাকাছিই। তাঁকে নিয়ে আগে লিখেছি, এজন্য পুনরাবৃত্তি করছি না। তবে জানিয়ে রাখি—দ্যলাক্রোয়া আর শোপাঁ আজীবন খুবই অন্তরঙ্গ বন্ধু ছিলেন, কাজের অনুরাগীও ছিলেন। শোপাঁ মারা যাওয়ার পর তাঁর মৃতদেহের কফিন পের লাশেজে বয়ে আনার কাজে কাঁধ দেন দ্যলাক্রোয়া।

অঁরে দ্য বালজাকের সমাধি এলো এরপর। স্তম্ভের ওপরে লেখকের একটি দৃষ্টিনন্দন আবক্ষ ভাস্কর্য রয়েছে, ডেভিড অঁজরের তৈরি, যাতে প্রকাশ পেয়েছে সেই চিরাচরিত কুচ-পরোয়া-নেহি-মার্কা তীক্ষ্ম চেহারা, আর সেই ঢেউখেলানো বন্যধাঁচের চুল। তবে বালজাকের সবচেয়ে বিখ্যাত ভাস্কর্য এটি নয়, সেটি ওগ্যুস্ত রোদাঁর তৈরি, নাম মনুমেন্ট টু বালজাক, অবস্থান প্যারিসের রোদাঁ জাদুঘর। বালজাকের একজন বিখ্যাত অনুরাগী বলা যায় রোদাঁকে। তিনি বালজাককে নিয়ে অনেক বেশি আবেশিত ছিলেন। একাধিক  ভাস্কর্যও গড়েছিলেন। তবে প্রচুর সমালোচনাও শুনেছেন। বিশেষ করে মনুমেন্ট টু বালজাকের জন্যই। ভাস্কর্যটি ঠিক প্রথাগত ধাঁচের না হওয়াতে সমালোচকরা একে ‘বিকৃত’, ‘বস্তায় ভরা কুনোব্যাঙ’ ইত্যাদি বিচিত্র অভিধা দেন। এমনকি ভাস্কর্যটি তৈরির কার্যাদেশ যারা দিয়েছিল, সেই ফরাসি লেখক সংস্থা পর্যন্ত প্রথাবিরোধী ভাস্কর্যটি গ্রহণ করতে অস্বীকৃতি জানায়। তবে পরবর্তীতে লোকে এর শক্তিশালী দিকগুলো বুঝতে সক্ষম হয়। বালজাক মানুষ হিসেবে যেমনটা ছিলেন—একজন শক্তিমান পুরুষ যিনি রীতিনীতির তোয়াক্কা করেন না, একগুঁয়ে, সাহসী—এই বিষয়গুলোই ভাস্কর্যটির মূল উদ্দেশ্য ছিলো। 

সাহিত্যে বাস্তববাদের (realism) জনক বিবেচনা করা হয় বালজাককে। পরিশ্রমী মানুষ ছিলেন। কখনো-কখনো টানা ১৫-১৮ ঘন্টাও লিখেছেন। যেহেতু রাত জাগতে হতো, কফির নেশা ছিলো মারাত্মক। দিনে এমনকি পঞ্চাশ কাপেরও বেশি কালো কফি খেয়েছেন এমনটা জানা যায়। খুঁতখুঁতেও ছিলেন, নিজের লেখা প্রচুর সম্পাদনা করতেন। মাঝে-মাঝে এজন্য অবশ্য বিপাকেই পড়তেন প্রকাশক, কারণ সময়মতো মুদ্রণ শুরু করা যেত না।

একটা মজার ব্যাপার হচ্ছে, প্যারিসে বালজাকের বাড়িতে দুটো দরজা ছিলো। সামনেরটা সদর, আর পেছনের গুপ্ত দরজাটির উদ্দেশ্য ছিলো ঋণদাতাদের তাগাদা থেকে পালানো। এছাড়া আজীবনই বিবাহিতা এবং তুলনামূলক বয়স্কা নারীদের ব্যাপারে বালজাকের ভয়ঙ্কর অবসেশন ছিলো। তেইশ বছর বয়সে তিনি মাখামাখি প্রেমে পড়েছিলেন যে প্রতিবেশী নারীর—তিনি ছিলেন পঁয়তাল্লিশ বছর বয়স্কা ও ৯ সন্তানের মা। শহুরে অপভাষায় তাঁকে মিল্ফ-লাভার বললেও বোধহয় খুব বাড়াবাড়ি হবে না!

এরপরের কবর রসিনির, যাঁকে ইতালির মোৎসার্ট নামে ডাকা হয়। দুর্দান্ত সব অপেরা কম্পোজ করেছেন। মাত্র ৩৭ বছর বয়সে অপেরা থেকে স্বেচ্ছা-অবসর নেন এবং অন্যান্য কাজে মন দেন। তাঁর বেশকিছু কম্পোজিশন পরবর্তীতে বিভিন্নভাবে অভিযোজিত হয়েছে। রসিনির সমাধি দেখতে ছোটোখাটো ঘরের মতো। সামনে লালরঙা দরজা। তার ওপরে চমৎকার অক্ষরে বড়ো করে রসিনি লেখা।

পের লাশেজে সবচেয়ে বেশি ফুল পড়ে যে-সমাধিতে সেটি এদিত পিয়াফের। আমি গিয়ে দেখি—ফুলের ভারে নুইয়ে পড়বে এমন অবস্থা। মজার ব্যাপার হলো গাঢ় লালরঙা একটা বিশেষ হাইব্রিড গোলাপের নামকরণই করা হয়েছে এদিতের নামে। তাঁকে শ্রদ্ধানিবেদনে এই ফুলই সবচেয়ে বেশি ব্যবহার করা হয়, তবে অন্যান্য ফুলও রয়েছে। এই লেখাটি যখন লিখছি তখনো আমি Non, je ne regrette rien শুনছি। এদিতের সবচেয়ে বিখ্যাত এই গানটা অনেকেরই পরিচিত, কারণ বিভিন্ন জনপ্রিয় মাধ্যমে এটি ব্যবহার করা হয়েছে।

সবশেষে যে-সমাধির কথা বলবো সেটি পের লাশেজের সবচেয়ে বড়ো তারকার—জিম মরিসন। সবচেয়ে বেশি দর্শনার্থী আসে এই সমাধি দেখতে। মাত্র সাতাশ বছর বয়সে প্যারিসে মারা যাওয়ার আগে জনপ্রিয়তার চূড়ায় পৌঁছে গিয়েছিলেন। প্রতিভাবান এই সঙ্গীতশিল্পীর মাদকের দোষ ছিলো বাড়াবাড়ি রকমের। মৃত্যুর কারণও তাই, এমনটা অনুমান করা হয়। তবে একে ঘিরে কিছু অসমর্থিত ষড়যন্ত্র-তত্ত্বের কথাও শোনা যায়। এর পেছনে সবচেয়ে বড়ো কারণ হলো লাশের কোনো ময়নাতদন্ত হয়নি। ষড়যন্ত্রের সপক্ষে কোনো তথ্যপ্রমাণ নেই অবশ্য।

উদ্দাম ভক্তরা যাতে মরিসনের কবরের কাছাকাছি ঘেঁষতে না পারে সেজন্য পের লাশেজ কর্তৃপক্ষ একটা ধাতব বেড়া দিয়ে রেখেছে। এরকমটা আর কোনো সমাধিতে দেখিনি। বোঝাই যাচ্ছে কী পরিমাণ লোকসমাগম হয়। আমাকেও কিছুক্ষণ দাঁড়াতে হলো, কারণ লোকের চাপে জায়গা পাওয়া যাচ্ছিল না। বস্তুত অন্য কোনো সমাধিতেই এই অভিজ্ঞতা হয়নি আমার।

মানুষের মৃত্যু হ’লে তবুও মানব
থেকে যায়; অতীতের থেকে উঠে আজকের মানুষের কাছে
আরো ভালো— আরো স্থির দিকনির্ণয়ের মতো চেতনার
পরিমাপে নিয়ন্ত্রিত কাজ
কতো দূর অগ্রসর হ’য়ে গেল জেনে নিতে আসে।

মানুষের মৃত্যু হ’লে | জীবনানন্দ দাশ

ছবিঘর

Gallery

ছবির উপর ক্লিক করে বড়ো আকারে দেখুন | Click on the image for a larger view

Share this with others

Leave A Comment

You May Like