জুল ভার্নের সঙ্গে একদিন

Published On: August 16, 2023 | Categories: Travelogue | Tags: , | Views: 37 | 0 Comments on জুল ভার্নের সঙ্গে একদিন |

০২৩ সালের গ্রীষ্মকাল। জুলাই মাসের শেষদিক। ইউনেস্কোতে ইন্টার্নশিপ করতে আসার প্রায় মাসখানিক হয়ে গেছে। বিকেলবেলা প্যারিসের এখানে-সেখানে ইতস্তত ঘুরে বেড়াই। বেশিরভাগ সময় একা-একাই। করার মতো বিশেষ কিছু নেইো। তবু প্যারিস ভালো লাগে। মাসকাবারি টিকিটের সুবাদের শহরের আশপাশেও খানিকটা ঘুরে ফেলেছি। তবে শহরের বাইরে তখনো যাওয়া হয়ে ওঠেনি।

প্যারিসের কোন জায়গাগুলোতে যেতে চাই, সেই তালিকা করার সময়ই অবশ্য জুল ভার্নের কথা ভেবেছিলাম। জানতাম, তিনি ফরাসি—আর কে-না জানে, বিখ্যাত আর সৃজনশীল ফরাসিদের চূড়ান্ত গন্তব্যস্থল প্যারিসই। কিন্তু ঘাঁটাঘাঁটি করতে গিয়ে আবিষ্কার করলাম, ভার্ন দীর্ঘসময় প্যারিসে ছিলেন ঠিকই, কিন্তু তাঁর স্মৃতিচিহ্ন বলতে যা বোঝায়, সেসব প্যারিসের বাইরে। কতোটা বাইরে? দেখলাম—খুব দূরে নয়। প্যারিস থেকে শ’দেড়েক কিলোমিটার দূরের ছোট্ট শহর আমিওঁ, যেখানে তাঁর শেষজীবন কেটেছে। সমাহিতও হয়েছেন সেখানকার সিমেট্রিতে, আর বাসভবনকে পরিণত করা হয়েছে জাদুঘরে।

জাদুঘরে ঢোকার টিকেটটা রিজার্ভ করতে হবে কিনা, সেটা দেখতে ওদের ওয়েবসাইটে গেলাম। ফ্রান্সের অনেক দর্শনীয় স্থাপনায় আগেভাগে রিজার্ভ করে যেতে হয়—তারিখ তো বটেই, এমনকি ক্ষেত্রবিশেষে সময়ের স্লট পর্যন্ত বুক করতে হয়—বিশেষ করে যেগুলোর জনপ্রিয়তা বেশি। অতিরিক্ত ভিড় কমানোর কৌশল আরকি। তা এখানে দেখলাম রিজার্ভ করার ঝামেলা নেই। অনলাইনে টিকেট বুক করার সুযোগ আছে, তবে না করলেও ক্ষতি নেই। স্ক্রল করতে করতে একদম নিচের দিকে একটা টইটুম্বুর রসগোল্লাকে ঘাপটি মেরে থাকতে দেখলাম। প্রতি শুক্রবার বিকেল সাড়ে চারটার পরে সকল দর্শনার্থীর জন্য জাদুঘরে প্রবেশ সম্পূর্ণ ফ্রি। এমনিতে টিকেটের দাম সাত ইউরো, অর্থাৎ খুব বেশি নয়—কিন্তু বাঁচাতে পারলে ক্ষতি কী? মুশকিল হচ্ছে, দিনটা ওয়ার্কিং ডে—মানে একটা দিন ছুটি নিতে হবে। ছুটি চাইলে সুপারভাইজর মানা করবে না এটুকু জানতাম, কাজেই সবার আগে বাসের রাউন্ড ট্রিপের টিকিটটা করে ফেললাম। প্যারিস থেকে বাস ছাড়বে সকাল ৯টায়, আর ফেরার বাস রাত ৯টায়। যাতায়াতের সময়টা বাদ দিলে ৯ ঘন্টার মতো হাতে থাকবে। যথেষ্টই। আসা-যাওয়ার টিকেটও সস্তা, মাত্র বারো ইউরো। যাওয়ার আগের কয়েকটা দিন ধরে খুঁজে খুঁজে বের করলাম আরো কিছু জায়গা। ৯ ঘন্টা দীর্ঘ সময়, সদ্ব্যবহার তো করতে হবে! দেখা গেলো, শহরটা ছোটো হলেও একেবারে ফেলনা নয়।

প্যারিসে সেন নদীর পাড়ে বেরসি পার্ক। সেই পার্কের পাশেই বাস টার্মিনাল, যেখানে থেকে দূরপাল্লার বাসগুলো ছাড়ে। চমৎকার বাস, রাস্তাও খাসা। ঘণ্টায় প্রায় একশো কিলোমিটার গতিতে যেতে যেতে আমি অবশ্য জুল ভার্নে‌র কথাই ভাবতে থাকি। একলাফে যেন শৈশবে চলে যাই নিমেষে। আমার বয়স তখন নয় কী দশ। এক বাল্যবন্ধুর বাড়ি গিয়েছিলাম। সেখানে আবিষ্কার করি একটা হার্ডকভার বই। নাম সাগরতলে। লেখকের নাম জুল ভার্ন। এই অদ্ভুতুড়ে নাম তো আগে কখনো শুনিনি। তখন অবশ্য বইপত্র বেছে পড়ার বয়স নয়—স্বভাবের কারণে যা পাই তা-ই পড়ে ফেলি। তবে এই বইয়ের প্রচ্ছদটা ছিলো বেশ আকর্ষণীয়—গাঢ় নীলজলের ভেতরে ভেসে বেড়াচ্ছে তিমির মতো দেখতে একটা ডুবোযান, আর ডুবুরির জবড়জং পোশাকে জলের বুকে হেঁটে বেড়াচ্ছে কেউ একজন, চারিদিকে রঙ্গিন প্রবাল। বইটা ছিলো শামসুদ্দিন নাওয়াবের অনুবাদ (অর্থাৎ কাজী আনোয়ার হোসেনের, কিংবা তাঁর গোস্ট রাইটারের? থাক, এসব কাসুন্দি না ঘাঁটাই মঙ্গল)। সেবা প্রকাশনীর বইয়ের একটা সমস্যা হলো, এরা মূল লেখাকে বিস্তর ছেঁটে ফেলে—সেটা অবশ্য বুঝেছি পরে। তবে ওইদিন আক্ষরিক অর্থেই গোগ্রাসে গিলেছিলাম বইটা, একটানা, আমার বন্ধুর বাড়িতে বসেই। লেখাটা আমার মনে রোমাঞ্চের একটা স্থায়ী ছাপ ফেলে যায়। পরে, অনেক পরে ইংরেজিতে সম্পূর্ণ সংস্করণটিও পড়েছিলাম। ততোদিনে আমি পাঠক হিসেবে অনেকটা পরিণত—তারপরও পড়তে গিয়ে শৈশবের সেই দুর্দান্ত অনুভূতিই যেনো ফিরে আসে আবারও। সেবার অনুবাদে যেসব খুঁটিনাটি বাদ পড়েছিলো, সেসগুলো পড়ে মুগ্ধতা বাড়ে শতগুণ। বিস্ময়কর ডুবোযান নটিলাসের বুকে চেপে রহস্যমানব ক্যাপ্টেন নিমো, তিমিশিকারী নেড আর প্রভুভক্ত কনসিলকে সঙ্গে নিয়ে সাগরের গূঢ় অন্ধকারে নিজেই ঝাঁপ দিই যেনো বারবার। একজন মানুষ কতোখানি কল্পনাশক্তির অধিকারী হতে পারে, তা ভেবে আজও বিস্ময়ের থই থাকে না আমার। পরে পড়েছিলাম তাঁর অ্যারাউন্ড দ্য ওয়ার্ল্ড ইন এইটি ডেজ। এরপর একে একে জার্নি টু দ্য সেন্টার অব দ্য আর্থ, ফাইভ উইকস ইন আ বেলুন, দ্য মিস্ট্রিয়াস আইল্যান্ড, ফ্রম দ্য আর্থ টু দ্য মুন, দ্য পার্চেজ অব দ্য নর্থ পোল, এবং আরও কিছু লেখা। ভার্ন আমাকে মুগ্ধ আর বিস্মিত করেছেন প্রতিবারই—শৈশব এবং কৈশোরের চমৎকার দিনগুলোকে করে তুলেছিলেন রঙিন। জুল ভার্ন তাই আমার কাছে স্রেফ একজন শিশুসাহিত্যিক নন, একটা স্বপ্নমাখানো অনুভূতির নাম।

পৃথিবীজুড়ে সবচেয়ে বেশি অনূদিত হওয়া লেখকের তালিকায় জুল ভার্ন আছেন দ্বিতীয় স্থানে। এক নম্বরে আগাথা ক্রিস্টি। অর্থাৎ, এমনকি উইলিয়াম শেক্সপিয়রের চেয়েও তাঁর লেখা বেশি ভাষায় ও সংখ্যায় অনুবাদ করা হয়েছে।

জুল ভার্ন জন্মেছিলেন প্যারিস থেকে চারশো কিলোমিটার দূরের নতেঁ শহরে। প্রথম জীবন সেখানেই কেটেছে। এরপর বাবার সিদ্ধান্তে আইন পড়ার জন্য তিনি প্যারিসে যান। কিন্তু মনেপ্রাণে তিনি সবসময়ই ছিলেন একজন লেখক। প্যারিসে থাকার সময়ে তিনি লেখক-শিল্পীদের আড্ডা বা সালোঁতে যাতায়াত করে, অনেক সাহিত্যিকের সংস্পর্শে আসেন, যাঁদের ভেতরে অন্যতম আলেকজান্দার দ্যুমা। এসব করে করে লেখালিখির ভূত আরো জেঁকে বসে তাঁর কাঁধে। শেষে আইনজীবী হবার ইচ্ছে বিসর্জন দিয়ে তিনি পেশাদার লেখক হবার সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেন। তাঁর বাবা এই সিদ্ধান্তে মোটেও খুশি হননি, আর দুজনের ভেতরে এটা নিয়ে বেশ মনোমালিন্যও হয়েছে। এর মাঝে ঘটলো এক অদ্ভুত যোগাযোগ। বন্ধুর বিয়ে উপলক্ষে প্রথমবার এসেছিলেন আমিওঁ শহরে। সেখানেই কনের বিধবা বোনকে মনে ধরে যায়। এরপর ভাববিনিময়, বিয়ে। প্যারিসে সংসারও করলেন কিছুদিন। কিন্তু একসময় জনাকীর্ণ প্যারিস ছেড়ে পাকাপাকিভাবে পাড়ি জমালেন আমিওঁ-তে। লেখালিখির জন্য সম্ভবত একটু নির্জন জায়গা খুঁজছিলেন। তখন তাঁর বয়স ৪৩। এরপর জীবনের বাকি চৌত্রিশটি বছর এই শহরেই কেটেছে। এখানে এসে দু-তিনটে ভাড়াবাড়িতে থেকেছেন। তার ভেতরে যেটায় ছিলেন সবচেয়ে বেশি সময় ধরে—সেটাই এখন জাদুঘর হিসেব সংরক্ষিত। ওটাই আমার গন্তব্যস্থল।

১১ আগস্ট, ২০২৩। আমিওঁতে নামলাম বেলা বারোটার দিকে। এই সময়টায় ফ্রান্সের আকাশ কিছুটা গোমড়া। জাদুঘরে যাবো সাড়ে চারটায়, অর্থাৎ অঢেল সময় হাতে। প্রথমে সিমেট্রিটা ঘুরে আসার সিদ্ধান্ত নিলাম, কারণ সেটা মূল শহর থেকে কিছুটা বাইরে। বাসে যেতে আধঘন্টার মতো লাগলো। গুগল ম্যাপ দেখে খুঁজে পেতে অসুবিধা হয়নি, কিন্তু ভেতরে ঢুকে কিছুটা ঘাবড়ে গেলাম। ইতোমধ্যে আমি প্যারিসের মঁপারনাস সিমেট্রি ঘুরেছি। প্যাটার্নে মিল আছে, তারপরও এটা একটু অন্যরকম। আঠারো হেক্টরের বিশাল এলাকা নিয়ে গড়ে তোলা সিমেট্রিটা প্রায় দুশো বছরের পুরোনো। দর্শনার্থী তেমন নেই বললেই চলে। বিরাট বিরাট গাছের ছায়ায় দিনের বেলাতেই জমাট হয়ে আছে চাপ চাপ অন্ধকার, সঙ্গে ঘন ঝোপঝাড়, হঠাৎ একটা সাপ মাথা তুললেও অবাক হবার কিছু ছিলো না। হাঁটাচলার রাস্তাঘাট অবশ্য ভালো। পঞ্চাশ কী একশো কী দুশো বছরের পুরোনো ভাঙ্গাচোরা শ্যাওলাধরা সমাধিগুলোর ভেতর দিয়ে হাঁটতে যে একটু অস্বস্তি হচ্ছিলো না, এমনটা দাবি করবো না। কয়েকটা ছবি থেকে আমার অনুভূতির সামান্য আভাস পাওয়া যেতে পারে।

মজার ব্যাপার হচ্ছে, এ-সময় আমার খুব করে মনে পড়ছিলো গোরস্থানে সাবধানের কথা, সিমেট্রিতে হাঁটতে হাঁটতে জটায়ু যেভাবে বলছিলেন—

দোহাই পামার সাহেব, দোহাই হ্যামিলটন সাহেব, দোহাই স্মিথ মেমসাহেব—ঘাড়টি মটকিও না বাবা, কাজে ব্যাগড়া দিয়ো না! তোমরা অনেক দিয়েচ, অনেক নিয়েচ, অনেক শিখিয়েচ, অনেক ঠেঙিয়েচ…ক্যাম্বেল সাহেব, অ্যাডাম সাহেব, আর—হুঁ হুঁ—তোমার নামের তো বাবা উচ্চারণ জানি না!— দোহাই বাবা, তোমরা ধুলো, ধুলো হয়েই থাকো বাবা, ধুলো…ধুলো…।

ভাবনাটা মাথায় আসতেই আমি হেসে ফেলি সশব্দে, পরক্ষণে নিজের হাসির শব্দে নিজেই চমকে যাই। বিতিকিচ্ছিরি ব্যাপার।

পাখির ডাক আর নিজের পায়ের শব্দের বাইরে আর কিচ্ছু নেই, কেউ নেই। এই শিরশিরে অনুভূতির ভেতর দিয়ে পায়ে-পায়ে জুল ভার্নের সমাধিতে পৌঁছলাম। খুঁজে পেতে খুব কসরত করতে হয়নি অবশ্য, কারণ এটাই এই সমাধিক্ষেত্রের সবচেয়ে বিখ্যাত সমাধি—ফলে কিছুদূর পরপরই দিকনির্দেশনা দেয়া আছে। তবে ঢোকার গেট থেকে খানিকটা ভেতরে হওয়াতে বেশ কিছুক্ষণ হাঁটতে হয়। সিমেট্রিটা আবার সমতলও নয়, উঁচুনিচু, ফলে হাঁটার খাটুনি একেবারে কম নয়।

সমাধির সামনে আমি চুপচাপ স্থির হয়ে থাকি অনেকক্ষণ। কী ভাবছিলাম? নশ্বর মানবজীবনে একজন মানুষ কতো বিচিত্র-বর্ণিল কাজ করে যেতে পারে, হয়তো সেটাই। সম্বিৎ ফেরে কয়েকজনের গলার স্বরে, সম্ভবত আমেরিকান, ওরাও এটা দেখতেই এসেছে।

জুল ভার্নের সমাধির নকশাকার আলবার্ট রোজ। ভাস্কর্যটা দেখে মনে হয় যেনো ভার্ন কবর ভেঙ্গে বেরিয়ে আসতে চাইছেন। প্রতীকী অর্থটা নিমেষে আমার জন্য অনেক তাৎপর্যময় হয়ে ওঠে। জুল ভার্ন তো বেঁচে আছেনই, পৃথিবীজুড়ে লক্ষ লক্ষ শেলফে, কোটি কোটি পৃষ্ঠায়, আর অজস্র মানুষের স্মৃতিতে। এই আমাকেও যেমন সুদূর আমিওঁতে টেনে আনলেন সেই কোন বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চল থেকে। এই যোগাযোগ অপার্থিব।

সেখানে আরো কিছুক্ষণ থাকার পর আমিওঁ শহরে ফিরতে মনস্থির করি। কিন্তু সেখানেই বাধলো গোল। শহরের বাইরের দিকে হওয়াতে খুব বেশি বাস এদিকটায় যাতায়াত করে না। পরের বাসটা অন্তত আরো ঘন্টাখানিক পর, এমনটাই দেখলাম অ্যাপে। তখন সামার চলছে। বাংলাদেশের মতো না হলেও মাথার ওপরে থাকা মাঝদুপুরের সূর্য মাঝে মাঝে বেশ চড়া হয়ে উঠছে। নয়তো এই পাঁচ কিলোমিটারের মতো রাস্তা কি হেঁটেই মেরে দেওয়া যেতো না? খুব যেত। অগত্যা বাসের জন্য অপেক্ষা করি। কিন্তু সময় কাটানো যায় কী করে? ম্যাপে দেখলাম, কাছেই একটা সরু নদীমতো আছে। অবশ্য খাল হলেই বা কে ঠেকাচ্ছে। বেশ তো, খালই সই। আমার তো আর কাউকে জবাবদিহি করতে হচ্ছে না যে—লোকের মুখে ঝাল না খেয়ে অখ্যাত খালেবিলে ঘুরে বেড়াচ্ছি কী করতে! অখ্যাত জায়গাগুলো বরং ভালো, ভিড় থাকে না, নিজের মতো অনেককিছু কল্পনা করে নেওয়া যায়, খানিকটা একান্ত সময়ও কাটে।

সেদিন যদি ওদিকে হেঁটে হেঁটে না যেতাম, একটা অপূর্ব দৃশ্য আমার দেখা হয়তো না। দুপাশে দীর্ঘ গাছের সারি, মাঝখান দিয়ে সরু পথ। তার ডানদিকে একটা ফার্ম‌হাউজ। কাঁটাতারের জালে ঘেরা, কোথাও আবার আছে সযত্নে ছাঁটা ঝোপ বা hedge। একটা ছোট্ট পরিবার সেই ফার্ম‌হাউজের দেখভাল করছে। স্বামী-স্ত্রী আর তাদের দুই ছেলেমেয়ে, যাদের বয়স দশ-বারোর বেশি নয়। বাচ্চাগুলোর পেছন পেছন ছুটে বেড়াচ্ছে একটা বাদামী-সাদা হাস্কি। ছোটো শহরের উপকণ্ঠের ওই ততোধিক ছোটো ফার্ম‌হাউজ আজও আমার চোখে ভাসে। জীবনের অন্যরকম মানে করতে ভালো লাগে।

ফার্মহাউজটার ছবি তোলা হয়নি, উচিতও হতো না। তবে পথ আর খালটার কিছু ছবি তুলেছিলাম।

এরপর বাসে করে শহরে ফিরলাম। জাদুঘরে যেতে তখনো ঢের সময় বাকি। কাছাকাছিই ছিলো নোত্র্‌ দা্ম (Notre Dame) ক্যাথেড্রাল, সেদিকে এগোলাম। গথিক স্থাপত্যধাঁচের এই ক্যাথেড্রাল স্থাপন করা হয়েছিলো ১২২০ সালে। আর প্যারিসের নোত্র্‌ দা্ম স্থাপিত হয় ১১৬৮ সালে, যদিও সেটার কাজ শেষ হতে লেগে যায় আরও প্রায় একশো বছর। দেখতেও এ-দুয়ের মাঝে মিল আছে, কিন্তু মজার ব্যাপার হচ্ছে, আমিওঁর ক্যাথেড্রালটাই আকারে বড়ো—প্যারিসের প্রায় দ্বিগুণ। প্যারিসের নোত্র্‌ দা্ম এখন দর্শনার্থীদের জন্য উন্মুক্ত নয়। ২০১৯ সালে অগ্নিকাণ্ডে ক্ষতিগ্রস্ত হবার পর থেকে এখনো সেটার সংস্কারকাজ চলছে—২০২৪ সালে প্যারিস অলিম্পিকের আগে সেটা দর্শনার্থীদের জন্য উন্মুক্ত করা হবে না। বাইরে থেকে অনেকটা দেখা যায়, কিন্তু চারিদিকে ঘিরে থাকা দৈত্যাকার ক্রেন আর লোহালক্কড়ের ভিড়ে ব্যাপারটা ঠিক জমে না। সৌভাগ্যক্রমে এই নোত্র্‌ দা্মটা দেখা হয়ে গেলো। চমৎকার বাহারি কারুকাজ ভেতরে আর বাইরে। ক্যাথেড্রাল থেকে অনতিদূরে আছে একটা বেল টাওয়ার। এটাও বেশ বিখ্যাত, ক্যাথেড্রালেরই সমসাময়িক। আজ অবশ্য সেটা বন্ধ। বাইরে থেকেই যতোটা দেখা গেলো।

সময়মতো জাদুঘর পৌঁছে দেখি, ইতোমধ্যেই বেশকিছু মানুষজন চলে এসেছে, তারাও সাড়ে চারটা বাজার অপেক্ষা করছে। বাইরে থাকতে থাকতেই বাড়ির কিছু ছবি তুলে নিলাম। বেশ ব্যতিক্রমী গড়ন। বাড়ির মূল নকশা একটুও বদলানো হয়নি। ভেতরের দেয়ালে জুল ভার্নের একটা ফটোগ্রাফ দেখে নিশ্চিত হলাম।

বাড়িটা বেশ বড়ো। জুল ভার্ন সস্ত্রীক এই বাসায় ভাড়াটে হিসেবে ছিলেন প্রায় আঠারো বছর। কক্ষগুলোও বেশ বাহারি। খাওয়া, পড়াশোনা, আপ্যায়ন, ধূমপান সবকিছুর জন্য আলাদা আলাদা ঘর। জুল ভার্নের প্রথম উপন্যাস ফাইভ উইকস ইন আ বেলুন-এর প্রকাশক পিয়েখ-জুলের অফিসরুমও এই বাড়িতেই ছিলো। তাঁরও অনেক স্মৃতিচিহ্ন এখানে আছে। সব ঘরই প্রয়োজনে কিছু কিছু সংস্কার করতে হয়েছে, তবে একমাত্র ব্যতিক্রম ভার্নের ডাইনিং কক্ষ, যেটা প্রায় অবিকৃতই রাখা সম্ভব হয়েছে—ছাদ থেকে শুরু করে আসবাবপত্র বা ফায়ারপ্লেস, সবই। এমনকি ব্যবহৃত তৈজসপত্রগুলো পর্যন্ত রক্ষিত আছে সযত্নে।

একে একে দেখা হলো ডাইনিং, বসার ঘর, ব্যক্তিগত গ্রন্থাগার। এই গ্রন্থাগারে হাজারেরও বেশি বই ছিলো। সেগুলো অবশ্য আর এখানে নেই।

একটা কাঠের সিঁড়ি রয়েছে, যা বেয়ে একদম অ্যাটিকে চলে যাওয়া যায়। সরু টাওয়ারটায় উঠে দেখা গেলো নটিলাসের মতো করে বানানো সাবমেরিনের একটা প্রোটোটাইপ কন্ট্রোল প্যানেল। এই সংযোজন অবশ্য পরে করা। জুল ভার্ন‌ের এসব রদ্দি জিনিস বানাতে বয়েই গেছে। বিশ্বাসযোগ্য ও বিজ্ঞানভিত্তিক কল্পনাকে তিনি এক অসামান্য উচ্চতায় নিয়ে গিয়েছিলেন। অবশ্য সাহিত্যিকদের কল্পনাশক্তিই তো সব। এই যেমন টলকিয়েন—কল্পনার চোখে যিনি একটা আস্ত ইউনিভার্সই বানিয়ে ফেলেছিলেন!

আমিওঁর মানুষের কাছে জুল ভার্নে‌র গুরুত্ব অসামান্য। ফলে শহরের অনেক জায়গাতেই ভার্নে‌র ভাস্কর্য কিংবা তাঁর লেখার চরিত্রদের ভাস্কর্য, বই সংক্রান্ত বোর্ড ইত্যাদি চোখে পড়ে। বোঝা যায়, মানুষটাকে তাঁরা ভালোবাসে, ধারণ করে। আমিওঁবাসী তো তবু জুল ভার্ন‌কে সশরীরে পেয়েছে। স্পেনের ভিগো শহরেও জুল ভার্নে‌র একটা ভাস্কর্য আছে, যদিও সেখানে তিনি কোনোদিনই যাননি। সেটা তৈরি হয়েছে কেবল এই কারণে যে—টোয়েন্টি থাউজ্যান্ড লিগস আন্ডার দ্য সি বইতে জুল ভার্ন‌ ভিগোর প্রসঙ্গ এনেছিলেন।

সন্ধ্যা নামতে থাকে। প্যারিসে ফিরতে হবে। যাওয়ার আগে আমিওঁর দিকে তাকাই। কী দুর্দান্ত একটা জীবন! আমাদের মানবজীবন কি আসলেই ক্ষুদ্র, নাকি আমরাই তাকে কেটেছিঁড়ে অকিঞ্চিৎকর বানিয়ে ফেলি—যেমনটা সেনেকা বলেছেন?

ধন্যবাদ, প্রিয় জুল ভার্ন‌, আমিসহ সমস্ত পৃথিবীর অজস্র ভাষাভাষী শিশুদের রঙিন শৈশবের জন্য।

ছবিঘর

Gallery

ছবির উপর ক্লিক করে বড়ো আকারে দেখুন | Click on the image for a larger view

Share this with others

Leave A Comment

You May Like